সব কিছু
facebook lakshmipur24.com
লক্ষ্মীপুর শনিবার , ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১২ই নভেম্বর ১৯৭০ | স্লাইকোন ভোলা

১২ই নভেম্বর ১৯৭০ | স্লাইকোন ভোলা

১২ই নভেম্বর ১৯৭০ | স্লাইকোন ভোলা

সানা উল্লাহ সানু: আজ  ১২ নভেম্বর উপকূলের ভয়ংকর ঐতিহাসিক দিন । ১৯৭০ সালের এই দিনে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস  দ্বীপ জেলা ভোলা এবং লক্ষ্মীপুরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানী ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে।

https://youtu.be/DDKGJRM0PY0

সেই স্মৃতি নিয়ে আজো যারা বেচেঁ আছেন এবং যারা আত্মীয় স্বজন হারিয়েছেন,সেই বিভীষিকাময় দিনটি মনে পড়তেই আতঙ্কে উঠেন তারা। দিনটি স্মরণে আজ দেশব্যাপী আলোচনা সভা, সেমিনার, কোরানাখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে বিশেষ দোয়া, মোনাজাত ও প্রার্থনার আয়োজন আছে।

ধারণা করা হয়, প্রলয়ংকারী ঐ দুর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়ে ছিল।  কিন্তু তৎকালীন বিভিন্ন বিশ্ব মিডিয়া থেকে লাখ লোক নিহত হওয়ার খবর প্রচারিত হয়। এর মধ্যে ভোলা জেলাতেই সর্বাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ঝড়টির নাম ছিল “ভোলা সাইক্লোন”। 

লক্ষ্মীপুরের সাবেক রামগতির চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। স্রোতে ভেসে যায় নারী শিশু ও বৃদ্ধসহ অসংখ্য মানুষ। সে রাতে এ জেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে রামগতির মেঘনা উপকূলীয় চরআবদুল্লাহ এখনকার কমলনগরের ভুলুয়ানদী উপকূলীয় চরকাদিরাসহ নোয়াখালীর হাতিয়াসহ, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় এটি হানা দেয়।

চারিদিকে লাশ আর লাশ, লাশের গন্ধে মানুষ কাছে যেতে পারেনি। ৩-১০ ফুটের জলোচ্ছাসের কারণে মাটি দেয়া যায়নি মৃত মানুষগুলোকে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এম সানাউল্লাহ্‌ নূরী’র সত্তরের প্রলয়-ভয়াল  ধ্বংসের কথা: “১৯৭০ সালের ঘূণিঝড় হলো কার্তিক মাসের ২৮ তারিখে অর্থাৎ বারোই নভেম্বর। ঢাকায় একদিন আগে ঠান্ডা দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির আলামত দেখেই বুঝে ছিলাম, আমাদের রামগতি, হাতিয়া এবং উপকূল অঞ্চলে কি ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে। আমি তখন দৈনিক বাংলায় (সাবেক দৈনিক পাকিস্তান) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করছিলাম। তখনকার প্রাদেশিক কৃষি দফতরে উচ্চপদস্থ অফিসার জনাব আবদুর রব চৌধুরী সিএসপি এবং রামগতির বর্তমান এমপি কে পরদিন টেলিফোন করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে বললেনঃ চলুন আমরা দুজনে একসঙ্গে গিয়ে রামগতির অবস্থা দেখে ‌আসি ।

সকাল ৮ টায় দিকে ঢাকা থেকে রাওয়ানা হয়ে সোজাসুজি আমরা রামগতি বাজারের নিকটবর্তী চর এলাকায় পৌছালাম। সেখানে স্তুপীকৃত লাশ এবং মৃত গবাদি পশুর যে হাল দেখলাম তা ভাষায় অবর্ণনীয়। রামগতি বাজারের একজন শৌখিণ ফটোগ্রাফার আমাকে ফুলের মতো ফুটফুটে চারটি শিশুর ছবি দিয়েছিলেন। সেটি আমি ছেপেছি দৈনিক বাংলায়। আবদুর রব চৌধুরী ঢাকার সাথে যোগাযোগ করে দুর্গত অঞ্চলের জন্য রিলিফ কমিশনারের জন্য দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমি আমার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের থেকে একটানা কয়েকদিন ধরে ঢাকায় দৈনিক বাংলার জন্য রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলাম। এতে কাগজের প্রচার সংখ্যা ত্রিশ হাজার থেকে একলাখে উঠেছিলো। চট্টগ্রামে সে সময় এক টাকা দামের কাগজ পাঁচ-ছ টাকা বিক্রি হচ্ছিলো।

আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধান ক্ষেতগুলোকে নাকে মুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিলো ধ্বংসস্তুপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে। গোটা উপকূল অঞ্চলে প্রায় অর্ধকোটি লোক মৃত্যু বরণ করেছে। সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হয়েছিলো এই প্রলয় ভয়াল দুযোর্গের খবর।”

৭০-এর বন্যায় রামগতি উপজেলার চর আব্দুল্লাহ ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৎসজীবি অধ্যুষিত সারা ইউনিয়ন প্রায় নারী-শিশু শূন্য হয়ে পড়ে। তারা আর এ মানুষ খেকো নদীর পাড়ে থাকতে চান না। ভীতসন্ত্রস্ত, আবার কখন হানা দেয়। চর আব্দুল্লাহর বাসিন্দা ইয়াসিন ভূঁঞা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সহকারী সচিব গর্ভনর হাউজে চাকরিরত। তার বাবা-দাদীসহ বাড়ির প্রায় সবাই ভেসে গেছেন পানির তোড়ে। হাজী আলী হোসেনের ষোড়শী মেয়ে ঢেউয়ের টানে কিভাবে হাত থেকে ছিটকে চলে গেল ইত্যাদি হাজারো বীভৎস বাস্তবতা। চর কোলাকোপা এলাকায় সিএসপি আবদুর রব চৌধুরীর ২২ জন আত্মীয়-স্বজন জলোচ্ছাসের কালো রাতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, তারা আর দিনের আলো দেখলো না। এ ধরনের হাজারো করুন নির্মম কাহিনী গাথাঁ ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর।

ওই দিনের ঘটনা প্রত্যেক্ষ স্বাক্ষী ইউনিয়ন কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কমলনগরের তোরাবগঞ্জ এলাকার হাজী নুরুল ইসলাম লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর ডটকম কে বলেন, সে বছর ১২ নভেম্বরের চার-পাঁচ দিন আগে থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, মাঝে মাঝে দমকা বাতাসসহ বৃষ্টি ও গুঁড়ি গুড়িঁ বর্র্ষা ছিল।

১১ নভেম্বর বুধবার থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি বেড়ে যায় এবং দমকা হাওয়া প্রবলতর হতে শুরু করে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া খুব খারাপ হতে থাকে, সন্ধ্যার পর শুরু হয় প্রলয়ঙ্করী ঝড় বৃষ্টি এবং মাঝ রাতে ফুঁসে উঠতে শুরু করে সমুদের পানি।

মধ্য রাতের পর তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসে বিপুল ঢেউ আকারের জলোচ্ছ্বাস। ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে লোকালয় থেকে লোকালয়, সমগ্র জনবসতির উপর। আর মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ, গবাদিপশু, বাড়িঘর এবং ক্ষেতের দাড়িয়েঁ থাকা ফসল।

পরের দিন আমরা নোয়াখালীর চর জব্বর গিয়ে দেখি পথে প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে পড়ে আছে কেবল লাশ আর লাশ। অন্য জেলার তুলনায় সে রাতে রামগতিতে তেমন বড় ক্ষতি হয়েছে এটা বলা যায় না। তবে আমরা আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে ছিলাম।

সত্তরের সেই কালো রাতের কথা মনে হলে ধুসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে, যারা বেঁচে আছেন তাদের।

তিনি আরো জানান আমরা টিভিতে এবং বাস্তবে দেখেছি বিভৎস সে দৃশ্যের মাঝে দেখা গেছে সাপ আর মানুষ জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা শিশু কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে।

সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এসব সংবাদ তৎকালীন পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সচিত্র প্রতিবেদন আকারে।

এসব সংবাদ বিশ্ববাসী জেনেছিল চারদিন পর। ’৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর বিভিন্ন অঞ্চলে লাশের সৎকার ও বেচেঁ থাকা মানুষদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রিলিফ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন দেশের হাজার হাজার মানুষ।

অথচ সেই সময়ের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান এবং তার সরকার এই দুর্যোগ সম্পর্কে কোন সতর্ক বার্তা প্রচার করে নি, রেডিও টিভি’র মাধ্যমে কোন আগাম সংবাদ প্রচার করেনি। এমন কি জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানার পর তিন দিন তারা এ খবর চেপে রাখে, রাষ্ট্রীয় মাধ্যেমে সঠিকভাবে প্রচার না করে এক দুই লাইনের দায়সারা সংবাদ প্রচার করে।

প্রথম তিন দিন স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসক ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্ধার ও ত্রাণ কাজ শুরু করা হয়নি। চারদিন পর বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের খবর সারা বিশ্বে প্রচার হবার পর পাকিস্তানী একনায়করা নড়েচড়ে বসে। যেখানে দশ লক্ষেরও বেশী মানুষ মারা গেছে বা নিখোঁজ

হয়েছে, সেখানে পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে প্রচার করা হয় তিন লক্ষ মানুষের কথা। অথচ তখনকার পাকিস্তানী মিত্র আমেরিকার সিয়াটো সংস্থা তাদের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছিল, প্রথম জোয়ারেই কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ মানুষ ভেসে গিয়েছিল।

আজ ১২ নভেম্বর ঐতিহাসিক সেই জলোচ্ছ্বাসে নিহত স্বজনদের স্মরণে লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর ডটকম গভীর শোক প্রকাশ করছে।

তথ্যসূত্র হিস্টোরিডটকম: লিংক http://www.history.com/this-day-in-history/tidal-wave-ravages-ea

দ্যা ওয়েদার:http://www.weather.com/storms/hurricane/news/deadliest-cyclone-history-bangladesh-20130605#/1

হারিকেন সাইয়েন্স: http://www.hurricanescience.org/history/storms/1970s/greatbhola/

আইবিটাইমস: http://www.ibtimes.com/hurricane-watch-1970-cyclone-bangladesh-killed-500000-302837

উইকিপিডিয়া: https://en.wikipedia.org/wiki/1970_Bhola_cyclone

 

 

 

 

 

জলবায়ু আরও সংবাদ

বৃষ্টির আশঙ্কা,বাড়তে পারে শীতের তীব্রতা

৫১ বছরেও লাখ লাখ নিহত উপকূলবাসীর স্মরণে কোন উদ্যোগ নেই

লক্ষ্মীপুরে মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারে হাজার হাজার মানুষ পানি বন্দি

উপকূল দিবসে কমলনগরে আলোচনা সভা ও দোয়া

ঝড়ে লাখ লাখ নিহতের স্মরণে আজ পালিত হচ্ছে “উপকূল দিবস’’

১৬-১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরসহ উপকূলে অধিক জোয়ারের শঙ্কা

লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয়ে অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রকাশনার নিবন্ধনের জন্য আবেদনকৃত, তারিখ: 9/12/2015  
 All Rights Reserved : Lakshmipur24 ©2012- 2024
Editor & Publisher: Sana Ullah Sanu
Ratan Plaza(3rd Floor), ChakBazar, Lakshmipur, Bangladesh.
Ph:+8801794822222, WhatsApp , email: news@lakshmipur24.com