তাবারক হোসেন আজাদ: ‘হেইযে পনর বছর আগে দল বাইন্দা হলে ছবি দেখতে যাইতাম, ভালা লাগতো, হাসি-আনন্দ করতাম। অন আর হেইদিন নাই। অন নইব্বার চা দোয়ানে দশ টিয়া দি চাই খাইলেই একটা ছবি দেখতাম হারি। আঙ্গো ঘরে টেলিভিশন নাই, পরিবার নিয়া ঘোরারও জায়গা নাই।
দুইহান ছিনেমা হল আছিলো, তাও অন বন্ধ অই গেছেগই’। চা দোহানের টেলিভিশনই অহন আমাগো বিনোদনের আড্ডাখানা’। আন্নেরা এগুন লিহি কি লাভ অইব? আঙ্গো কাছে আইছেন যহন এককাপ চা খাই যানগি।’- আক্ষেপ আর হতাশা দিয়ে কথাগুলো বললেন রায়পুর উপজেলার মিতালী বাজার এলাকার দিনমজুর হোসেন মিয়া। কথাগুলো হোসেন মিয়া বললেও এটিই এখন এখানকার অধিকাংশ সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনের কথা।
রায়পুরে ‘তাজমহল’ ও ‘বাঁশরী’ নামে দু’টি সিনেমা হল থাকলেও প্রায় ৭/৮ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এখানে নেই কোনো শিশু পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র। দৃস্টিনন্দন মরা ডাকাতিয়া নদী প্রাকৃতিক লেকের সৌন্দর্য ছড়ালেও তা দখলদাররা দিন দিন ভরাট করে জবরদখল করায় সেটিও এখন আগের স্থানে নেই। তাই বিনোদন প্রেমী মানুষের এখন ভরসা স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি। আবার যাদের এ দু’টির সংশ্রব নেই তারা ছুটে চলেছেন এলাকার চা দোকানগুলোতে। এক একটি চা দোকান এখন এক একটি ‘মিনি সিনেমা হল’।
রায়পুরে দুটি সিনেমা হল থাকলেও তা বন্ধ রয়েছে প্রায় ১৫ বছর। নেই কোন শিশু পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র। তাই চা দোকানগুলিই এখন মিনি সিনেমা হলে পরিনত হয়েছে। প্রতি বছর বাজেট হলেও কোন উদ্যেগ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। এতে হতাশ ও উদ্ধিগ্ন রয়েছে বিনোদন পিপাসু মানুষ।
জেলা শহরে রয়েছে একটি শিশু পার্ক ও দশটি সিনেমা হল। হ্যাপি ছাড়া অন্য ৯টি সিনেমা হলই বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শিশু পার্কে ঘুরতে আসা পাঁচ উপজেলার মানুষ হতে হয় নানা বিড়ম্ভনা ও হয়রানির শিকার।
সরজমিনে ও কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাতে জানা যায়, সদর উপজেলায় অবস্থিত হ্যাপি ছাড়া, ঝুমুর, চন্দ্রগঞ্জের সমতা, রামগঞ্জ উপজেলায় জাবেদ, রায়পুর উপজেলায় তাজমহল ও বাশুরী, রামগতি উপজেলায় বর্নালি, আলেকজান্ডারে বানি, কমলনগর উপজেলায় রীতা, হাজিরহাট মেঘনা,সুমন সিনেমা,মতিরহাটের মিতালী নামে ১০টি সিনেমা হল প্রায় ৮-১৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
এসব সিনেমা হলে অশ্লিল ছবি প্রদর্শন, ফিল্ম মূল্য বৃদ্ধি না পাওয়া, দর্শক কমে যাওয়া বন্ধ রয়েছে বলে দর্শকদের মতামত।
পৌর শিশু পার্কে ঘুরতে আসা রায়পুরের দুই গৃহবধু জানান, হলগুলোতে পরিবেশ না থাকায় ছবি দেখা হয় না। বৃহস্পতি ও শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চাদের চাপে পড়ে ১৫ কিলোমিটার পাড়ি সদরের এই শিশু পার্কে এসেছি।
তাও আবার উপযুক্ত মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে আসলে নানা প্রতিবন্ধকতা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে ঘরে বসে স্যাটেলাইটে অনুষ্ঠান দেখি। তাই প্রতিটি উপজেলায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মান ও তা পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানাই।
এ প্রসঙ্গে হ্যাপী সিনেমা হলের মালিক মোজ্জামেল হায়দার মাছুম ভূইয়া বলেন, ১৯৮৬ সালে ৫০ শতাংশ জমির উপর হলটি নির্মান করেন। ভালো ছবি প্রদর্শন হলে প্রায় ১২০০ দর্শকের আগমন ঘটে। ফিল্ম মূল্য বৃদ্ধি না পাওয়ায়, খরচ বেশি হওয়ায় সিনেমা হলের ধ্বস নেমেছে।
তাছাড়া ডিজিটাল নির্মানে ব্যায় কমছে এবং সিনে কমপ্লেক্স পরিকল্পনা আছেন বলে দাবি করেন। প্রতিনিয়ত ভালো ভিডিও পাইরোসি হলেও দর্শকও ভালো হয়। সরকারে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরো বেশি বিনোদন সুবিধা দিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
রায়পুরের পৌর মেয়র এবিএম জিলানি বলেন, ডাকাতিয়া নদী সংলগ্ন টিসি সড়কের পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত ৩ একর জায়গায় শিশু পার্ক নির্মানের জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকার আবেদন জমা দিয়েছি জেলা প্রসাশকের কাছে। আবেদনটি পাশ হলে রায়পুরবাসির জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র উপহার দিতে পারব বলে আশা করছি।
সিনেমাহলগুলোতে ভালো পরিবেশ ও ছবি না থাকায় মানুষ এখন আর হল মুখি নেই। এখন বাসায় ও চায়ের দোকান গুলোতে বসে বিনোদন উপভোগ করে। ঠিক একই মন্তব্য করেছেন রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি পৌর সভার মেয়রগন।
এ প্রসঙ্গে বন্ধ থাকা রায়পুর তাজমহল সিনেমা হলের মালিক হাজী ইসমাইল খোকন বলেন, ভালো ছবি নির্মান হওয়ায় এবং অর্থ সংকটের কারনে হল বন্ধ করে দিয়েছি। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ও ভালো নির্মান হলে আবার হল চালু করতে পারি। একই কথা বললেন বন্ধ থাকা অন্য ৮টি সিনেমা হলের মালিকগন।
জেলা প্রসাশক জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। চার উপজেলায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মান ও সিনেমা হল গুলোর পরিবেশ দেখে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
0Share