সানা উল্লাহ সানু | লক্ষ্মীপুরটোয়েন্টিফোর
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়। অতীতে এসময়ে ক্ষেতে কোন আমন ফসল ছিল না। কিন্ত চলতি জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখের পরেও শতশত একর জমিতে আমন ধান দাঁড়িয়ে রয়েছে। একেবারে সবুজ কাঁচা ধান। যে গুলো পাকতে আরো ১৫-২০ দিন সময় লাগবে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেতে শুধু গাছ আছে, ধান নেই। ধানের শীষ বের হচ্ছে না অথবা বের হলেও ধান ছিটা। ক্ষেতের আইলে বসে এমনটি বলেছিলেন, কৃষক আনোয়ার (৬০) এবং কৃষক মতিউর (৫৫)।
লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার অনেকগুলো এলাকার মাঠ জুড়ে রয়েছে এমন করুণ দৃশ্য । ধানের এমন করুণ অবস্থায় কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। কৃষকরা বাধ্য হয়ে কাঁচা সবুজ ধান কেটে গরুর ঘাস হিসেবে ব্যবহার করছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারিগঞ্জ ইউনিয়ন এবং নোয়াখালীর সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী মাইজচরা গ্রাম। এ গ্রামের কৃষক আনোয়ার । বন্যার কারণে পর পর ৫বার বীজ লাগিয়েও চারাগাছ নষ্ট হয়ে যায়। ৬ষ্ঠ বার বাজার থেকে ধানের চারা কিনে জমিতে লাগিয়ে ছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন হয়তো ভালো ফলন পাবেন। অক্টোবরেই জমি শুকিয়ে গিয়ে ছিল। ধানে কয়েক বার সেচ দিয়েছিল কৃষক। কিন্ত জানুয়ারির ১৫ তারিখেও গাছ থেকে শীষ বের হচ্ছে না। ধান পাবেন বলে আর আশা নেই। তাই এখন সবুজ ধান গাছ কেটে ফেলছেন। কৃষক আনোয়ার জানান, ৪০ শতক জমিতে সব মিলে তার প্রায় ১৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। হাতে কোন কাজও নেই তার। তাই দুঃচিন্তায় রয়েছেন আনোয়ার।
কমলনগরের চর কাদিরা গ্রামের কৃষক মতিউর ও কামাল । পাশাপাশি জমিতে তারা ৪ বারের পর ৫মবার বীজ লাগিয়েছেন। কিন্ত তাদের সে কষ্টের ধানে কোন ফলন নেই। তারা দুজনই ঘাস হিসেবে সবুজ গাছ কেটে গরুকে খাইয়ে ফেলছেন।
মাঠঘুরে দেখা গেছে নোয়াখালী সদর, লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার শতশত একর জমিতে এখন এমন অবস্থা রয়েছে। এতে হতাশ হয়ে গেছে কৃষকরা। অনেক কৃষক সবুজ ধান গরুর ঘাস হিসেবে বিক্রি করে ফেলছেন। অনেকে ধান গাছ কেটে নতুন করে সয়াবিন চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন।
স্থানীয় ভাবে জানা গেছে ২০২৪ এর আগষ্টের ভয়াবহ বন্যায় নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার মধ্যে যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সেগুলোর মধ্যে গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ কৃষক ও শ্রমিক। আয়ের আর বিকল্প উপায় না থাকায় তারা সবাই চাষাবাদ করেন।
বন্যার পর বীজ না থাকা সত্ত্বেও তার দূরদূরান্ত থেকে বীজ সংগ্রহ করেছিলেন ফলনের আশায় । কিন্ত বর্তমানে ফলন না পেয়ে তারা আবারো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
কিন্ত এবার ধান নিয়ে কৃষকদের এমন অবস্থা কেন হলো ? তা জানতে চেয়েছি কয়েকজন কৃষক থেকে। চর কাদিরা গ্রামের কৃষক আবুল কালাম, কৃষক তুহিন জানান কৃষকদের নেশা চাষাবাদ করা। কিন্ত গত বছরের আগষ্টের ভয়াবহ বন্যার পর তারা ধান লাগাতে পারেনি। কৃষকরা কেউ কেউ ৫-৬ বার বীজতলা তৈরি করে কেউ ব্যর্থ হয় কেউ চারা উৎপাদনে সফল। হয়। কৃষকরা প্রথমে নিজের বীজ পরে বাজারের বীজ এবং অনেকে সরকারি প্রণোদনার বীজে ধান লাগিয়ে ছিল। কিন্ত সে ধানের গাছে ফলন আসছে না। কেউ কেউ মনে করছে বিলম্বে ধান লাগানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছে ধানের জাতে গড় মিল হয়েছে। যা ই হোক হাজার হাজার কৃষক একেবারেই পথে বসে গেছে।
কৃষকদের এমন পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক সামছুদ্দিন মোঃ ফিরোজ বলেন, বন্যার পর লক্ষ্মীপুর জেলা ব্যাপি লাগানো আমন ধানের ৬০ ভাগে ফলন ভালো হয়েছে। তবে অনেক কৃষকের ধান নষ্ট হয়েছে শুনেছি। সুনিদির্ষ্ট তথ্য দেয়ার পর তিনি জানান, আমন ধান আলোক সংবেদনশীল উদ্ভিদ। মূলত বিলম্বে লাগানোর কারণেই এমন সমস্যা হয়েছে। অন্যদিকে প্রণোদনার ব্রিধান-৭৫ জাতে কোন ফলন আসেনি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
জেলা ত্রাণ ও দূর্যোগ এবং কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে ২০২৪ সালের আগষ্টে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলায় ৩ ধাপে বন্যা হয়। এমন বন্যার কারণে লক্ষ্মীপুর জেলার ৮৩ হাজার ২শ হেক্টর জমির মধ্যে মাত্র ৪৫ হাজার ৭শ ৭০ হেক্টর জমিতে আমন ধান লাগানো হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ধানের ৬০ ভাগ ঘরে তুলেছে কৃষক।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বন্যার কারণে লক্ষ্মীপুরে ১ লাখ ৫৭ হাজার ২০৯ জন কৃষক-কৃষাণীর ২২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয় । এমন পরিস্থিতিতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ৬ হাজার কৃষককে ৫কেজি ধান বীজ, ২০ কেজি সার এবং ১ হাজার টাকা নগদ সহায়তা করা হয়েছিল।
কিন্ত কৃষকদের অভিযোগ প্রণোদনা হিসেবে প্রদানকৃত ব্রিধান-৭৫ এবং বিআর-১৭ ধান ছিটা এবং কোন ধানই হয়নি। এমন অভিযোগে কৃষি বিভাগ বলছে অসময়ে লাগানো ধানে এমন সমস্যা হয়েছে।
0Share