মিসু সাহা নিক্কন :রামগতি উপজেলার রামগতি বাজার সংলগ্ন মেঘনা নদীর তীরে শত শত পরিবারের স্বপ্ন আজ মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে কেউ হারাচ্ছে ঘর-বাড়ি, বসত-ভিটা, ফসলের মাঠ, গাছ-পালা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাবা-মা’র এমনকি পূর্বপুরুষের শেষ ঠিকানা (কবর) টুকুও। প্রিয় মানুষের হাসি ও স্বপ্ন আজ রাক্ষুসী মেঘনার ভাঙ্গনে শেষ হয়ে গেছে। তার পরেও থেমে নেই মেঘনার ভাঙ্গন। সবকিছু হারিয়ে পরের জায়গায় একটু মাথা গোজাবার জন্য ঠাঁই নেয় অসহায় নদী গর্ভে বিলীন হওয়া মানুষগুলো।
সরেজমিনে রামগতি মাছঘাট এলাকায় গেলে দেখা যায় ভাঙ্গনের করুন চিত্র। বর্তমানে বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, রামগতি আছিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রামগতি রব্বানিয়া ফাযিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, রামগতি বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামগতির ঐতিহ্যবাহী দায়রা বাড়ি, রামগতি বাজার মেঘনার ভাঙ্গনের তোপের মুখে। অন্যদিকে বড়খেরী ইউনিয়নের রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেঘনার তীরে। যেন দেখার কেউ নেই! স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙ্গনের বিষয়ে নির্বিকার রয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে এই বর্ষা মওসুমে মেঘনার করাল গ্রাসে দক্ষিণ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রামগতি বাজার বিলীন হয়ে যাবে।
রামগতি বাজার ব্যবসায়ী ও রঘুনাথপুর এলাকাবাসী দু:খ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি, দোকানঘর মেঘনার ভাঙ্গন থেকে বোধহয় শেষপর্যন্ত রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যখন বাজার থেকে ট্রলারের শব্দ কানে আসে তখন নিজেদের বড় অসহায় মনে হয়। যদি সঠিক সময়ে নদীর ভাঙ্গন রোধে সঠিক নজরদারী করা না হয় তাহলে আমাদের সবকিছু নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাবো। আগুনে পুড়লেও কিছু থাকে কিন্তু নদী ভাঙ্গলে কিছুই থাকে না। আপদকালীন সময়ে বরাদ্দকৃত(একনেক) ১৯৮কোটি টাকার প্রকল্প থেকে অন্তত ১ কোটি টাকার কাজ করা হলে এই বর্ষা মওসুমে কোনভাবে রামগতি বাজার সহ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বিশ্বের মানচিত্রে যে দিন বাংলাদেশের জম্ম হয়েছে ঠিক সেদিনই বাংলার মানচিত্রে জম্ম হয়েছে রামগতির। যে মাটিতে জম্ম নিয়েছে শাহাদাতুল আহম্মেদ সাহেবের মত পীর কেবলা, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারী আ.স.ম. আবদুর রব, সি.এস.পি. আবদুর রব চৌধুরী, মেজর (অব:) আবদুল মান্নান, পীর মোমিন হুজুর, ভবানী সাহা, আব্দুল রসিদ হাওলাদার, হাজী আহম্মদ মিয়া, মীর মোহাম্মদ হোসেন, মুজিবুর রহমান পন্ডিত সাহেবসহ আরও অনেক জ্ঞানীগুনি। রামগতি ও কমলনগরের স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আবদুল্লাহ আল মামুন এবং রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ এর বাসস্থান ভাঙ্গন কবলিত বড়খেরী ইউনিয়নে। পীর কেবলাসহ অনেকে গুমিয়ে আছেন রামগতির মাটিতে, এই এলাকায় আছে অনেক মাদ্রাসা, স্কুল ও উচ্চ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে গিয়ে যাঁরা বাংলাদেশ পরিচালনা করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে তাঁদেরি মাতৃভূমি পীর আওলিয়ার জম্মস্থান রামগতি আজ মেঘনার করাল গ্রাসে নদীগর্ভে বিলীনের পথে। সম্প্রদায়িক সাম্প্রতিক সমন্বয়ের আদি পুরোদা ভবানী চরন সাহার জম্মস্থান রামগতিতে যিঁনি যুগ যুগ ধরে অসম্প্রদায়িক চেতনায় বহু অনুদান অবদান দিয়েছিলেন। রামগতি বি.বি.কে. পাইলট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও শ্রী শ্রী মদন গোপাল জিউর আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা এবং রামগতি ষ্টেশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৯নং চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের জমিদাতা স্বর্গীয় ভবানী চরন সাহা, কিন্তু আজ মদন গোপাল জিউর আশ্রম ও সে পুরোদ্বার সমাধীস্থল মেঘনার করাল গ্রাসে বিলীন হওয়ার পথে তাই কাঁদছে হাজার হাজার ভক্ত। প্রতি মুহুর্তেই ভাঙ্গছে ঘর-বাড়ী, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সড়ক, ফসলী জমি এইভাবে চলতে থাকলে একসময় বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে রামগতি উপজেলা নামক স্থানটি মুছে যাবে।
রামগতি আছিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল রাজ্জাক বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের সামনে মেঘনা নদী চলে এসেছে। প্রতিদিন জোয়ারের পানি আমদের স্কুলে প্রবেশ করায় আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনেক শঙ্কিত।
বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (ভার:) মো: হাসিবুল ইসলাম জানান, আমাদের ফাঁড়ির পুকুর পাড় গতকাল (৫ আগস্ট) মেঘনা নদীর ভাঙ্গনে ভেঙ্গে যায়। জোয়ারের পানি ফাঁড়ি পর্যন্ত চলে আসায় আমরা খুবই চিন্তিত।
বড়খেরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ ফেরদৌস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ইউনিয়নের তিন ভাগের দুই ভাগ ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রঘুনাথপুর গ্রামের পল্লীমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ সহ শত শত মানুষের বসত বাড়ি নদীগর্ভে বিলীনের পথে। বিভিন্ন মহলে রাক্ষুসে মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধের বিষয়ে আলোচনা করেও এখন পর্যন্ত কোন সুফল পাইনি। আলেকজান্ডার ৩১ শয্যা হাসপাতালের সামনে ভাঙ্গনরোধে যে কাজ করা হচ্ছে তা যদি আমার ইউনিয়নে দশ ভাগের এক ভাগ করা হতো তাহলে নদী ভাঙ্গনরোধ করা সম্ভব ছিলো।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী গাজী ইয়ার আলী বলেন, রামগতি বাজার সংলগ্ন কোন খালে রেগুলেটর না থাকায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রামগতি মাছঘাট থেকে ১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু করা হবে।
প্রসঙ্গত, মেঘনা নদীর ভাঙন রোধে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর এলাকায় বাঁধ নির্মাণে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার অনুমোদন করে একনেক। ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) প্রথম পর্যায়ে ১৯৮কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দকৃত টাকায় রামগতিতে এক কিলোমিটার, আলেকজান্ডারে সাড়ে তিন কিলোমিটার এবং কমলনগরে এক কিলোমিটার বাঁধ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিলো। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৯ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন আলেকজান্ডার এলাকায় সাড়ে তিন কিলোমিটার কাজ বাস্তাবায়ন করছে। যে কারণে ওই এলাকায় নদী ভাঙন প্রতিরোধ হয়েছে।
একই সময়ে রামগতি উপজেলার রামগতি বাজার সংলগ্ন ১ কিলোমিটার ও কমলনগর উপজেলার মাতাব্বর হাট এলাকায় ১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ চলতি বছরের প্রথমে শেষ হবার কথা। কিন্তু সময়ক্ষেপন করে এখনো কাজ শুরুই হয়নি। যথাসময়ে কাজ শুরু না করায় নির্মাণ কাজে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবে এমনটাই দাবি রামগতি বাজার ব্যবসায়ীদের।
0Share