সানা উল্লাহ সানুঃ দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম হয়েছে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার শেষে সবে বালিশে মাথা রেখেছিলেন এক স্কুলশিক্ষক। আচমকা বিকট চিৎকার?’ তারপর এক ভয়ঙ্কর বাজনা। বিছানা থেকে একলাফে উঠে ঘরের আলো জ্বেলে ওই শিক্ষক ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। তাঁর স্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘‘ঘুমিয়ে পড়ো। পাশের বাড়িতে তোমার ছাত্রীর বিয়ে ছেলেপিলেরা গান বাজিয়ে নাচছে। আর ঘুম! বালিশের নীচে মাথা রেখেও ভোর পর্যন্ত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি ওই শিক্ষক। পরের দিনও বুক ধড়ফড় করছিল।’’ নভেম্বরের মধ্য সপ্তাহের একটি ঘটনা এটি।
এটা ঢাকা শহরের কোন কোন স্কুল শিক্ষকের একা অভিজ্ঞতা নয়। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মতো একটি অনুন্নত এলাকার অধিবাসিদের বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন নয়, প্রায়শই বিয়েতে ঘটছে এমন ঘটনা। বিয়েতে এখন ছেলে মেয়েরা মেতে ওঠে ডিজে নামক ভয়ংকর শব্দ পার্টিতে। শুধু কমলনগরই নয়, লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ এবং রামগতির মতো এলাকার প্রায় বিয়েতে হয় এমন ডিজে পার্টি।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডিজের আওয়াজ সাঙ্ঘাতিক। বিয়েতে আনন্দ করতে গিয়ে রাতভর ডিজে বাজিয়ে এলাকার লোকজনকে সমস্যায় ফেলা হচ্ছে। বিষয়টি সহ্যের বাইরে চলে গেলেও রাতবিরেতে কেউ সাহস পান না প্রতিবেশীর বিয়েতে গিয়ে প্রতিবাদ করার।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ডিজে পার্টির ছেলেমেয়েরা প্রতিবেশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, ছোট শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধ নারী পুরুষ কোন দিকেই খেয়াল রাখে না। অথচ বছর কয়েক আগেও এমনটা ছিল না।
কমলনগরের ডিজে প্রতীকের (ছদ্ম নাম) কথায়, ‘‘ওই আওয়াজটাই তো আসল মজা। আগের দিনের সাউন্ড সিস্টেম তো এখন পানসে হয়ে গিয়েছে। বিয়েতে ওসব আর চলে নাকি!’’ তার কথায় অন্য আয়োজনে কমতি থাকলেও ডিজে কিন্তু থাকবেই। নাহলে অন্যদের কাছে মান থাকবে না।
কয়েক দিন আগে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন এমন অভিভাবক রহমান বলেন ‘‘ওদের মান রাখার খপ্পরে পড়ে আমাদের জানটাই না হারায়!’’ তিনি আরো, “এখনকার ছেলেদের এটাই রেওয়াজ। ওই ডিজের আওয়াজে বুক ধড়ফড় করে। তার পরার্মশ হচ্ছে প্রশাসনের উচিত বিষয়টির লাগাম টানা।’’
কমলনগরের হাজিরহাটের এক মাইক ব্যবসায়ী জানান, পুরনো সাউন্ড সিস্টেম দোকানে পড়ে রয়েছে। সকলেই ডিজে চাইছেন। বিয়েতে এর চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক ডেকোরেশন এবং টেলিকম দোকান ডিজে ভাড়া দিচ্ছে। বিভিন্ন হাট বাজারে তৈরি হয়েছে ডিজে ক্লাব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের এক এসএসসি পরীক্ষার্থী বলেন, এবার নির্বাচনী পরীক্ষার সময় পাশের বিয়েবাড়িতে ডিজে বক্সের শব্দ সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়েছিল। মনসংযোগে খুবই সমস্যা হয়েছে। যতক্ষণ গানবাজনা চলছিল ততক্ষণ পড়া হয়নি। মাথা ধরেছিল।
ওই ছাত্রী বলেন, “শব্দ দূষণের বিষয়টি দেখা প্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাজে একজনের আনন্দের নামে দশ জনের অসুবিধা প্রশাসনের দেখা উচিত। তবে এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সদর থানা এবং কমলনগরের দু পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
শীত শুরু হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে শুরু হয়েছে বিয়ের মৌসুম। পথে-ঘাটে যেন সানাইয়ের সুর। আরো বাজছে বিয়ের নানা ধরনের বাজনা। একটা সময় ছিল বিয়ে মানেই সানাইয়ের সুর। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরে এখন সানাই সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়ে এসেছে ডিস্ক জকি (ডিজে), ব্যান্ড পার্টি ইত্যাদি। এখন ব্যান্ডের বাদ্যবাজনা ছাড়া বিয়ের কথা কল্পনাই করা যায় না। ডিজে বলতে বোঝায় ডিস্ক-জকি। উন্নত সাউন্ড-সিস্টেমে বাজানে হয় রেকর্ডেড বাজনা। ইদানিং এর কদর বেড়েছে বিয়ে বাড়িতে। উচ্চ সাউন্ডে গান ছেড়ে ছেলে মেয়েরা নাচে গানের তালে তালে। আর এই ডিজে দৌরাত্ম্যে রাতের ঘুম উধাও হওয়ার জোগাড় হয়েছে গ্রামবাসির।
0Share