জুনাইদ আল হাবিব, কন্ট্রিবিউটর: আকাশে ঘন ঘন মেঘের বিচরণ। বজ্রপাতের হুঙ্কার থেমে নেই। উত্তরা ঝড় মাঠ থেকে কৃষক কূলকে তাড়ায়। তিন-চার মাস যে কৃষক মাঠে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজেছেন। ফলিয়েছেন স্বপ্নের ফসল। সে কৃষক ওই ফসল মাঠ থেকে ঘরে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু দুভার্গ্য। ক্ষণিকের মাঠে একটু ঠাঁইও মিলছেনা কৃষকের। পর পর ঝড়ের আঘাত, অতিমাত্রায় বৃষ্টি। এতে কৃষকের স্বপ্ন পানির কাছে ঠেকেছে। বলছিলাম, লক্ষ্মীপুরে রবি শস্য কৃষকের হাতছাড়ার গল্প। টানা তিন বছর চলছে এ এক করুণ গল্প। সয়াবিনে বৃষ্টির ছোবলের গল্প।
জেলার কমলনগর, রামগতি, সদর ও রায়পুরের এমন কোন মৌজা নেই, যেখানে সয়াবিনের চাষ নেই। এছাড়াও অন্যান্য এলাকায় মরিচ, বাদামসহ অন্যান্য রবি শস্য উৎপাদন হয়েছে। ধার-দেনা আর ঋণের চাপে বেড়েছে কৃষকের দুঃশ্চিন্তা। কৃষকরা জানিয়েছেন, গত বছর এবং আগের বছর এমন সময়ে একই দশায় তারা মাথায় হাত রেখে কেঁদেছেন। এবারও ঠিক এর ব্যাতিক্রম নয়। ফসলের ওপর পানি আর পানি। পানির সাথে রবি শস্যের রাসায়নিক বিক্রিয়া চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, পানিতে ভাসছে সয়াতেল, মরিচতেল ও বাদামিতেল। কিছুদিন পর হয়তো তারা ফসল ঘরে তুলে স্বপ্ন পূরণ করতেন। ধার-দেনা, ঋণের বোঝা পরিশোধ করতেন। কিন্তু তা হলো না। প্রতিদিনের দফায় দফায় ঝড়-ভারি বৃষ্টি ফসলহানি ঘটাচ্ছে।
কমলনগরের চর মার্টিনের কৃষক আবদুল হাদি(মুন্সি)। বয়স প্রায় ৬০এর কাছাকাছি। তিনি জানান, “৪৮শতাংশ জমিতে সয়াবিন আর ৩২শতাংশ জমিতে মরিচ ফলিয়েছি। মাত্র ২৩কেজি মরিচ বিক্রি করেছি। এখনো সয়াবিন ঠিকমতো পাকেনি। কাঁচা সয়াবিন কীভাবে কাটি? এ সয়াবিন ঠিকমতো রোদে শুকানো যাবে না। ভালো দামে বিক্রিও করতে পারবো না। এতে ক্ষতির আশাঙ্কাও করি।” অতিবৃষ্টিতে এসব অঞ্চলে জলাবদ্ধতা প্রকট রূপ পরিগ্রহ করে। এমনটিই জানালেন মেঘনাপাড়ের কৃষক আবুল কাশেম। বয়স ৭০বছর।
কৃষিকাজ করেই জীবন চলে। শনিবার(৫মে) সকালে সয়াবিন কাটতে ক্ষেতে গিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, “বদলা ও নাতিদের নিয়ে সয়াবিন কাটতে এসেছি। ভাবলাম আকাশের অবস্থা তেমন ভালো না। তাই একটু আগেভাগেই সয়াবিন কাটতে গিয়েছি। কিন্তু বৃষ্টি ক্ষেত থেকে তাড়িয়ে দিছে। পরে পাশের এক বাড়িতে বৃষ্টিতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয় নিয়েছি। ওই বাড়িতে আসতে আসতে ভারি বৃষ্টিতে শরীর ও কাপড় ভিজে গেছে। পরে ক্ষেতে গিয়ে দেখি, বৃষ্টির পানি ক্ষেতে অথৈ। এ পানি সরানোরও কোন ব্যবস্থা নেই।” আবদুর রহমান দুলাল। বয়স আনুমানিক ৬৫তে দাঁড়িয়েছে।
একই অভিযোগ করে তিনি বলছিলেন,
“গত বছরের এমন দিনেও একই পরিস্থিতির মুখে পড়েছি আমরা। বৃষ্টি হলে ক্ষেত থেকে পানি সরানোর জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। এ সমস্যার কারণে শুনেছি সরকার খাল খনন করবে। তাও করেনি। ফসলের কোন ক্ষতিপূরণও পাইনি।”
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের মধ্যে লক্ষ্মীপুরে উৎপাদন হয় প্রায় ৮০ ভাগ। গত তিন বছর আগে এ জেলায় ৩৯ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষাবাদ করা হলেও চলতি বছর জেলার পাঁচটি উপজেলায় চলতি মৌসুমে ৫০ হাজার ৫০৫ হেক্টর আবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৪০ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৭ হাজার ৯৫০ হেক্টরের বিপরীতে ৫ হাজার ৬৭০ হেক্টর, রায়পুর উপজেলায় ৭ হাজার ৯৬০ হেক্টরের বিপরীতে ৫ হাজার ৫৪০ হেক্টর, রামগঞ্জ উপজেলায় ৮৫ হেক্টরের বিপরীতে ৮০ হেক্টর, রামগতি উপজেলায় ১৮ হাজার ২০০ হেক্টরের বিপরীতে ১৫ হাজার ৭০০ হেক্টর এবং কমলনগর উপজেলায় ১৬ হাজার ৩১০ হেক্টরের বিপরীতে ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ করা হয়েছে, যা চলতি মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১০ হাজার ৩১৫ হেক্টর কম জমিতে আবাদ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি একর সয়াবিন উৎপাদনে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। যার বিক্রয় মূল্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অল্প পুঁজিতে কম সময়ে অধিক টাকার ফলন পাওয়ায় সয়াবিনকে সোনার ফসল হিসেবে চিনেন সয়াবিন চাষীরা। গত মৌসুমে সোনার ফসল সয়াবিনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকৃতি। আবার চলতি মৌসুমের শুরুতেও অতিবৃষ্টিতে সয়াবিন আবাদে চাষীদের বেগ পেতে হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত অতিবৃষ্টিতে জলবদ্ধতায় ৯০শতাংশ সয়াবিন পঁচে গেছে। যাতে অন্তত ২’শ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
0Share