কাজল কায়েস: একসময়ের সন্ত্রাস আর খুনাখুনির জনপদ হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর এখন অনেকটাই শান্ত। লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে সন্ত্রাস দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, স্থানীয় পুলিশ-র্যাব ও প্রশাসনের তত্পরতায় শান্তি ফিরছে। পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দুটি ইস্যুতেই ভরসা করছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে দৃশ্যমান জনসমর্থন থাকলেও বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রাম জমাতে পারেনি। আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভক্তির কারণে দলটির হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীক ধানের শীষই তাদের পুঁজি।
আরো পড়ুন: রায়পুরে আ. লীগের ভয় জাপা নড়বড়ে ‘খালেদার ঘর’
রামগঞ্জ আসনে ফুরফুরে আ. লীগ অস্বস্তিতে বিএনপি
লক্ষ্মীপুর পৌরসভা ও সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৭৬ নম্বর নির্বাচনী এলাকাটিতে তিন লাখ ৯ হাজার ২০৫ জন ভোটার। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৫৬ হাজার ২১৯ এবং নারী এক লাখ ৫২ হাজার ৯৮৬ জন।
দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন বছর ধরে লক্ষ্মীপুরে মূলত তিন নেতার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু, সাধারণ সম্পাদক নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র আবু তাহেরকে ঘিরে নেতাকর্মীরা বিভক্ত। সাম্প্রতিককালে সদর আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শাহজাহান কামালকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী করায় দলের কিছু নেতাকর্মী তাঁর দিকে ঝুঁকেছে। যদিও জনশ্রুতি রয়েছে, লক্ষ্মীপুরে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক অভিভাবক নেই।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানিয়েছে, দলের জেলা শাখার সভাপতি আবুল খায়ের ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু ও তাঁদের অনুসারীদের দ্বন্দ্ব গত ছয় মাস ধরে প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আবুল খায়ের ভূঁইয়াকে সমর্থন দিচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ
উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ের আন্দোলনেও দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে আসছে। গত ৩০ মে জিয়াউর রহমানের ৩৭তম শাহাদাত্বার্ষিকী উপলক্ষে পৃথকভাবে দোয়া ও ইফতার মাহফিল করে দুই পক্ষ।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছবিসংবলিত পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকা। আসনটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত থাকলেও গত স্থানীয় সরকার ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের শাহজাহান কামাল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৩ সালেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নব্বইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দশম সংসদ ছাড়া বাকি সব নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগ : বিমানমন্ত্রী শাহজাহান কামাল ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন দলের লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটির সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু, সজিব গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সাত্তার ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের ধর্মবিষয়ক উপসম্পাদক সোয়েব হোসেন ফারুক।
শাহজাহান কামাল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় লক্ষ্মীপুরসহ সারা দেশে সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। আমার এলাকায়ই ইতিমধ্যে রাস্তা, স্কুল-কলেজসহ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় প্রায় তিন শ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরে জনগুরুত্বপূর্ণ যে ২৭টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করেছেন তা বাস্তবায়নে আমি কাজ করছি। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার সরকারের বিকল্প নেই।’
গোলাম ফারুক পিংকু নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি নিয়মিত ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে উঠান বৈঠক, সভা-সমাবেশ ও ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জনগণের কাছে সরকারের সাফল্য তুলে ধরছেন। এ সময় তিনি শেখ হাসিনার জন্য নৌকা প্রতীকে ভোট চান।
পিংকু বলেন, ‘একসময় সন্ত্রাসের জনপদ ছিল লক্ষ্মীপুর। আওয়ামী লীগ সরকারই কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মূল করে জনগণকে শান্তিতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন, সাফল্য তুলে ধরে আমি প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। দলে আমার ত্যাগ ও শ্রমের মূল্যায়ন করে জননেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।’
এম এ সাত্তার বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের একজন আদর্শিক কর্মী হয়ে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে যাচ্ছি। দলের হয়ে মানবিক সমাজ গঠনে জনগণের জন্য কল্যাণমুখী কাজ করছি। প্রতিটি ইউনিয়নে ছিন্নমূল মানুষকে ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছি। নেত্রী যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন তাহলে মনোনয়ন দেবেন।’
এম এ হাশেম বলেন, ‘শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আগেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছি। নেতাকর্মী ও জনগণের সুখ-দুঃখে পাশে ছিলাম। আমাকে মনোনয়ন দিলে আসনটি উপহার দিতে পারব।’
বিএনপি : বিএনপি থেকে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবু মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি এবং পরে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাঝে-মধ্যে এলাকায় দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং হামলা-মামলার শিকার নেতাকর্মীদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন তিনি।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দল সুসংগঠিত। বিএনপি আন্দোলনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। এর মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তির পরই অধিকার আদায়ের জন্য নির্বাচনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’
সাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, ‘নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আমি সব আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। হত্যার উদ্দেশ্যে আমাকে গুলি করা হয়েছে। তবুও আমি দলের আদর্শচ্যুত হইনি। সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে আমি দলকে সংগঠিত রেখেছি। ত্যাগ ও শ্রমের মূল্যায়ন করে দল আমাকে মনোনয়ন দিবে বলে আমি আস্থা রাখি। আমার সঙ্গে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা রয়েছে।’
অন্যান্য দল : আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম আর মাসুদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বেলাল অংশ নেবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
মাসুদ বলেন, ‘দলের দুঃসময়ে ২০০৮ সালে আমি লক্ষ্মীপুর-২ ও ৩ আসনে প্রার্থী ছিলাম। পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত কারণে দলের সিদ্ধান্তে আমি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছি। দল আমাকে যেখানেই মনোনয়ন দেয়, আমি নির্বাচনের জন্য সার্বিক প্রস্তুত রয়েছি।’
জেএসডি নেতা সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘জনগণ যেন স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারে—সরকারকে সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। খুনোখুনি আর সন্ত্রাস বন্ধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে আমি নির্বাচনে অংশ নেব।’
0Share