আব্দুল মান্নান আকন্দ: সময় বদলে গেছে, বদলেছে চলচ্চিত্রের ভাষা, গল্প, প্রেক্ষাপট সহ সবকিছু কিন্তু বাঙালির রুচিবোধের মানোন্নয়ন হয়নি একচুলও, পালাবদলের এ এক বিপরীতমুখী বিপ্লব বলা যায়। সময়ের দাবীতে সবচেয়ে বেশি বদলেছে নির্মাণ কৌশল। খানিকটা সহজ হয়েছে কিংবা বৈশ্বিক সামঞ্জস্যতা পেয়েছে।
এমন বাস্তবতায় “তোর সুখে আমার সুখ” ওয়েব মুভিটিকে নিঃসংকোচে বলতে হয় সাদামাটা গল্পের অনবদ্য উপস্থাপনা। চিরচেনা প্রেমকাহিনীর বিয়োগান্তক পরিনতি। নায়িকার পর্দা উপস্থিতির বয়স বিবেচনায় অবশ্য একপক্ষীয় টিনএজ প্রেমের নির্মম পরিনতিও বলা যায়। আলাউদ্দিন সাজুর কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে রবিবার “শোবিজ বাংলা” ইউটিউব চ্যানেল এ মুক্তি পেয়েছে ওয়েব মুভিটি।
ব্যক্তিগতভাবে পরিচালককে চিনি বলেই জানি যে, তিনি নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি মিরাক্কেল ঘটনা ঘটিয়েছেন। অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে ৪২ মিনিট ৬ সেকেন্ডের একটি ওয়েব মুভির স্যুটিং করেছেন মাত্র একদিনে। চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে বিশেষ মেধাবী হলেই কেবল এমনটি করা সম্ভব।
গল্প সংক্ষেপ: এনজিও কর্মী নয়ন ভালোবাসে মনিকে। বাধ সাধে মনির আত্ম অহমিকা সম্পন্ন বাবা, ভদ্রলোক খানিকটা রাশভারি প্রকৃতির। মনির সৎ মা নয়নের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেয়ার প্রয়োজনে সম্পর্কটিকে মেনে নেয়। আবার একসময় স্বামীর মতের পক্ষেও সায় দিতে দেখা যায় তাকে। মনিকে নয়নের সাথে না মিশতে সাবধান করে দেয়া হয়, মনি কিছু একটা করতে বলে নয়নকে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কাজী অফিসে গিয়ে মনিকে বিয়ে করে সে। মনির ক্ষুব্ধ বাবা মেয়েকে নয়নের কাছ থেকে জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে মনির অমতে জনৈক ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হয় তার। মনির সকল ইচ্ছা অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে বাবা মা দুজনেই আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে মনিকে আরেকবার বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য করে। এই বিয়ের আগে মনি তার বাবার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে নয়নকে প্রত্যাখ্যান করে। ঘটা করে বিয়ের আয়োজন চলতে থাকে দুই পরিবারের মধ্যে। এই শোক সইতে পারেনা নয়ন। বিপথগামী হয়ে পরে সে। তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার প্রতিজ্ঞা করে। জনবিচ্ছিন্ন এক পোড়োবাড়িতে নেশাগ্রস্ত জীবনযাপন করতে শুরু করে সে। এদিকে বিয়ের রাতেই বাসরঘরে চিরকুট লিখে রেখে বিষপানে আত্মহত্যা করে মনি, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে মনির ডাক্তার স্বামী। একদিন পোড়োবাড়িতে পালাতে গিয়ে জনৈক ছিঁচকে চোরের সাথে দেখা হয় নেশাগ্রস্ত নয়নের। সেসময় নয়ন অসুস্থ হয়ে পড়লে ছিঁচকে চোর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাক্রমে মনির ডাক্তার স্বামী নয়নের চিকিৎসা করতে গিয়ে বুঝতে পারে এই সেই নয়ন যার জন্য তার স্ত্রী আত্মাহুতি দিয়েছে। মনির আত্মহত্যার কথা জানায় সে নয়নকে, তার বুকপকেটে স্বযত্নে ভাঁজকরা মনির লেখা চিরকুটটি নয়নের হাতে দিতেই নয়ন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই হলো ট্রাজেডিক লাভ স্টোরি “তোর সুখে আমার সুখ”! মূলত পরিচালক এখানে “সুখ” শব্দটিকে স্যাটায়ার অর্থেই ব্যাবহার করতে চেয়েছেন বোধকরি। প্রেমিক যুগল একে অন্যের শোকে আত্মাহুতি দিয়ে সুখি হতে চেয়েছে কিংবা আরেক জনমে দুজন দুজনের হয়ে সুখি জীবনের প্রত্যাশায় দেহত্যাগ করেছে তারা।
চোরের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে ফ্ল্যাশব্যাক-এ গল্প বলার রীতিটি চলচ্চিত্রের পরিভাষিত কাহিনী বিন্যাসের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছে পুরোমাত্রায়। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের একটি গল্পকে সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। এই দক্ষতার প্রশংসা তাকে করতেই হয়। নয়নের ভালো গুণাবলি বুঝাতে গিয়ে রক্তদানের মতো মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করার অংশটুকু স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে নাগরিকদের কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণিত করবে নিশ্চিত।
নয়ন ও মনির ভূমিকায় ইউসুফ রাতুল এবং সাদিয়া জান্নাত সময়ের চাহিদা পূরণ করেছেন। রোমান্টিক দৃশ্যে দৃষ্টিনন্দন অভিনয় করেছেন দুজনেই তবে নেশাগ্রস্ত নয়ন আরেকটু মনোযোগী হলে ভালো লাগতো। এনজিও কর্মী নয়নের বেশভূষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনে হয়েছে। মনিকে চরিত্রের চাহিদা অনুযায়ী কমবয়সী লেগেছে, অনেকটা স্কুল গোয়িং স্টুডেন্টের মতো। ভারি মেকাপে বয়সটা আরেকটু বাড়ানো যেতে পারতো। মনির মায়ের ভূমিকায় মঞ্চাভিনেত্রী রাফিয়া আক্তার রেশমা পুরো সময় জুড়েই ছিলেন প্রাকৃতিক গুণে ভরপুর। সেই তুলনায় বাবার ভূমিকায় আব্দুল মান্নান আকন্দকে অনেকটাই রোবটিক মনে হয়েছে। ভালো লেখক হলেই ভালো অভিনেতা হয়না তিনি তার প্রমান দিয়েছেন পদেপদে। মনির স্বামীর চরিত্রে সোহেল চৌধুরী সাজ্জাদকে সবসময়ই সুখী মানুষ মনে হয়েছে, এমনকি স্ত্রীর মৃত্যু দৃশ্যেও। এটা তার অতীব সুন্দর মুখশ্রীর জন্যই হয়তো। ছিঁচকে চোরের চরিত্রটি আপাদমস্তক ভালো লেগেছে, এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে খানিকটা সামাজিক অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ডালিম কুমার দাস টিটুর মনোমুগ্ধকর অভিনয় চরিত্রের চাহিদা পূরন করেছে ভালোভাবেই, তবে ছিঁচকে চোরকে ব্র্যান্ডের সদ্য ভাঁজভাঙা রঙ্গিন জামা পড়েই কেনো চুরি করতে হয়েছিলো বুঝা গেলোনা। অজ্ঞাত কারণে মনির মৃত্যুর পর বাবা মায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। দশ সেকেন্ডের জন্য হলেও শব্দহীন কান্নার দৃশ্য সংযোজিত হতে পারতো।
স্বল্প উপস্থিতিতে সাবলীল ছিলেন, ঘটক চরিত্রে রিয়াজুল ইসলাম জাকির, মনির শশুর সাইফুল মুনির বেলাল, নয়নের বন্ধু রাজিব হোসেন রাজু, কাজীর ভূমিকায় মোহন, ডাক্তারের বোনের ভূমিকায় সামান্তা সহ অন্যরা সবাই।
আসমা আক্তার রুবিনার সম্পাদনা এবং আরিফুল ইসলামের সিনেমাটোগ্রাফিতে মুন্সিয়ানার ছাপ রয়েছে নিঃসন্দেহে। আবহসঙ্গীতে মীর হাসান স্বপন চাহিদা পূরনে সক্ষম হয়েছেন তবে সিনেমাটিক আবহের অতৃপ্তি রয়েই গেছে। গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী নাফেলের প্যারোডি সুরের গানের পরিবর্তে পুরনো দিনের সিনেমার গান ব্যবহৃত হতে পারতো। প্যারোডি সুর শুদ্ধ সংগীত চর্চাকে ব্যহত করে।
দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের এই দুঃসময়ে ওয়েবসাইট নির্ভর শৈল্পিক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। “তোর সুখে আমার সুখ” সার্বিকভাবে এমনই একটি ভালো উপস্থাপনা। অধিকাংশ অপেশাদার শিল্পীদের সমন্বয়ে মাত্র একদিনে এমন একটি সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা পরিচালকের অসামান্য শিল্পবোধেরই বহিঃপ্রকাশ। ধন্যবাদ আলাউদ্দিন সাজু এবং পুরো টিমের প্রতি।
লেখক: কবি ও গল্প লেখক এবং একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত
0Share