অমিত রহমান: দেশ জ্বলছে। পুড়ে ছারখার হচ্ছে জনপদ। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস। মানুষ মরছে। এটা আর কোন খবর নয়। কতজন মারা গেল, তা-ও কেউ জানতে চায় না। কারণ, মৃত্যুর কাফেলা প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। তবে কিভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে তা নিয়ে এখন নতুন আতঙ্ক। পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছে- এটা দেখতে দেখতে মানুষ ভাবলেশহীন। মনে হয় যেন এটা নিয়তি। মানুষ মরবেই এই স্বাধীন দেশে। কারও যেন কিছু বলার নেই। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে ঢুকে গুলি করে ছাদের ওপর থেকে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য! মিডিয়ায় কতটুকু খবর আসছে। মিডিয়া জুড়েই থাকছে সহিংসতার খবর। অবশ্য সহিংসতা কাম্য নয়। যারা গাড়িতে, বাড়িতে, ট্রেনে বাসে আগুন দেয় ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আনতে হবে আইনের আওতায়। কিন্তু তা কি আমরা দেখছি? আইনের লোকেরা বেআইনি কাজ করছে। জনজীবনে ভয়-ভীতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এর মাধ্যমে। ক’দিন পর এটাও হয়তো মানুষ মেনে নেবে। বলবে আপাতত আমি নিরাপদ। দেখি না কি হয়। আপনিও যে এ থেকে মুক্তি পাবেন না এটা কি করে ভাবছেন। বিপদ যে কোন সময় আসতে পারে। বন্দুকের কোন দিক নেই। যে কোন সময় যে কোন দিকে ঘুরে যেতে পারে। এই যখন অবস্থা তখন মিডিয়া কি করছে। মানুষ চেয়ে আছে মিডিয়ার দিকে। মিডিয়া কি সঠিক দায়িত্ব পালন করছে। আমরা কি হলফ করে বলতে পারি সাদাকে সাদা বলছি। সমালোচকরা বলেন, মিডিয়া উসকে দিচ্ছে। আমি সেটা বলবো না। এই যুক্তির সঙ্গে আমি একমত নই। তবে জনগণের প্রত্যাশা আর উদ্বেগের সঙ্গে একমত। তারা চান যা ঘটছে তার প্রতিফলন সংবাদ মাধ্যমে। সহিংসতার খবরের পাশাপাশি মানুষ চায় কেন এই পরিস্থিতি হলো তারও ব্যাখ্যা বর্ণনা। মানুষ দগ্ধ হচ্ছে। এটা মানবো কি করে। এটা তো রাজনীতি নয়। রীতিমতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পুলিশ যে পাখির মতো গুলি করছে সেটা কতটুকু লেখা বা বলা হচ্ছে। এটা তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ। সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলে পুলিশ এরকম মারমুখো হবেই। কারণ, তাদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে কোন অবস্থাতেই যেন সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া হয়। এর পরিণতিতে রাজনীতিতে হিংসাত্মক তৎপরতা আমরা দেখছি। ১৬ কোটি মানুষ এখন অসহায়। তারা কি করবে কোথায় যাবে তার কোন দিকনির্দেশনা নেই। সরকার প্রধান বলছেন, আর বরদাশত করা হবে না। ভাল কথা, এখানে একচোখা নীতি হলে চলবে না। বাস্তবকে স্বীকার করতে হবে। আসাদ কিংবা গাদ্দাফি হওয়ার চেষ্টা করলে বিপদ কমবে না, বরং বাড়বে। কারণ, মনে রাখতে হবে এই ভূখণ্ডের মানুষ কখনও উগ্র শাসকদের মেনে নেয়নি। বিভিন্ন মতে বিভক্ত এই জনগোষ্ঠী এক সময় এক প্লাটফর্মে গিয়ে হাজির হয়। তখন কোন দল থাকে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর পরই মানুষকে প্রতিবাদী হতে দেখা গেছে। মানুষ যখন বুঝে ফেলবে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন সে প্রতিবাদী হবেই। নৈরাজ্য এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে। এ থেকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকেই এগিয়ে যায় কোন দেশ। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে আমরা তাই দেখছি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতি অসুস্থ। রাজনৈতিক শূন্যতায় কাবু গোটা দেশ। বিনা ভোটে সংসদ গঠন করা হচ্ছে। সরকার বা নির্বাচন কমিশন লজ্জা না পেলেও জনগণ লজ্জা পাচ্ছে। এ অবস্থায় মিডিয়ার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। মিডিয়া ছাড়া আর কে দাঁড়াবে জনগণের পাশে। বিভক্ত মিডিয়া কি বিভক্তই থাকবে। না কি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলবে? মিডিয়া যদি সঠিক দায়িত্ব পালন না করে একদিন রাজনৈতিক নেতাদের মতো মিডিয়াকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই মিডিয়ার। এরশাদ জমানার শেষ দিকে মিডিয়া যে দায়িত্ব পালন করেছে তা এখনও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ
রেখে সাংবাদিকরা পথে নেমে এসেছিলেন। ব্যবসায়ীরা বিলম্বে হলেও রাজপথে নেমেছেন। এটাই বাস্তবতা। জনগণ চায় মিডিয়াও একই ভাবে দেশরক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হবে। মিডিয়া যদি সময়মতো এই দায়িত্ব পালন না করে তাহলে শুধু বিশ্বাসযোগ্যতাই হারাবে না, জনবিচ্ছিন্নতার দিকেই এগিয়ে যাবে। যা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। মিডিয়াকে সত্যের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা একবাক্যে বলছেন না- অনেক হয়েছে, আমরা দেশে শান্তি চাই। একটি নির্বাচনের জন্য দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে না। মানুষের শান্তি কেড়ে নিতে পারে না। দেশের অস্তিত্বে টান পড়তে পারে না। দুই নেত্রীকেই আজ বুঝতে হবে সব যদি আগুন সংস্কৃতিতে হারিয়ে যায় তাহলে তারা রাজনীতি করবেন কোথায়? ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতার মালিক যদি জনগণ হয় তাহলে জনগণের মনের কথা বুঝতে হবে। এই মুহূর্তে জনগণ বলছে- অনেক হয়েছে। আর আমরা রক্তপাত চাই না। হিংসা হানাহানি চাই না। দেশকে বাঁচাতে চাই। কে ক্ষমতায় থাকবেন বা আসবেন এটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। গীতা সেনের ভাষায় বলতে হয়, আমরা আপনাদের বানাই, আপনারা আমাদের বানান না।
সূত্র: মানবজমিন
0Share