মাইন উদ্দিন পাঠান | ১৯২৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম লক্ষ্মীপুরে এসেছিলেন। লক্ষ্মীপুর শহরের প্রধান ডাকঘরের সম্মুখে ‘কবি নজরুল এভিনিউ‘ লেখা নামফলকটি এখন আর নেই। দক্ষিণে সামাদ উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে পূর্বে দক্ষিণ তেমুহনী পর্যন্ত সড়কটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়েছিল। এ পথ ধরে তিনি নোয়াখালী থেকে আসেন এবং এ পথ ধরে তিনি চাঁদপুরের পথে প্রত্যাবর্তন করেন।
সে স্মৃতিবহ পদার্পণকে স্মরণে ধরে রাখার জন্য ১৯৯৬ সালে আমরা ক’জন পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে এ সড়কটি এ মহান কবির নামে নামকরণের দাবী তুলেছিলাম। আমাদের আরো দাবী ছিল, সামাদ উচ্চ বিদ্যালয় মোড়ের উত্তর কোণে কিংবা টাউন হলের সামনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি ‘মনুমেন্ট’ তৈরী করা। পৌর চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান চৌধুরী মিন্টু রাজী হয়েছিলেন। আমি এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটে যোগাযোগ করেছি। পরে নানা কারনে আর হয়ে উঠেনি। ১৯৯৭ সালে পৌর কর্তৃপক্ষ সড়কটির নামকরণ করেছেন। কিন্তু নামকরণটির সার্থক বাস্তবায়নের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বিগত ১৮ জুন আমরা নজরুল একাডেমির উদ্যোগে বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব রাজীব কুমার সরকার এর সাথে সাক্ষাৎ করি এবং নজরুল একাডেমির পাঁচটি প্রত্যাশা তুলে ধরি। জনাব রাজীব কুমার সরকার বিদগ্ধজন। তিনি শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়মিত চর্চা করেন এবং একজন স্বনামধন্য লেখক। জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদের প্রত্যাশাপত্র গ্রহণ করেন এবং দ্রুত পুরণের আশ্বাস দেন। এসময় পৌর প্রশাসক জনাব জসিম উদ্দিন, শিক্ষাবিদ প্রফেসর জেড এম ফারুকী, আমি প্রফেসর মাইন উদ্দিন পাঠান, নজরুল একাডেমির সভাপতি সেলিম উদ্দিন নিজামি, সম্পাদক কার্তিক সেনগুপ্ত, কবি এস এম জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক রাজিব হোসেন রাজু উপস্থিত ছিলেন।
১৯৯৭ সালে আমাদের এ দাবীতে কবি আবু হেনা আবদুল আউয়াল অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে ২০০০ সালে প্রকাশিত তার লেখা ‘বাংলাদেশে নজরুল: সফর ও সংবর্ধনা’ নামক গ্রন্থের লক্ষ্মীপুর পর্বে নজরুলের লক্ষ্মীপুর যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ পর্ব লেখার পূর্বে তাঁর সাথে আলাপচারিতায় আমি তাঁকে নজরুলের এ সফর সম্পর্কে একটি তথ্য দিয়েছিলাম। যা তিনি উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় তুলে ধরেছেন। তথ্য ছিল, তাফাজ্জল হোসেইন রচিত ‘স্মৃতিকণা’ গ্রন্থে নজরুলের লক্ষ্মীপুর সফর বিবৃত হয়েছে। তাফাজ্জল হোসেইন হলেন চৌমুহনী কলেজে স্বনামধন্য ‘প্রিন্সিপাল টি হোসেন’। তিনি তৎকালে (১৯২৬) লক্ষ্মীপুর মডেল হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এ স্কুলটির বর্তমান নাম ‘লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়’। স্কুলটি জাতীয়করণকালে লক্ষ্মীপুর মডেল হাই স্কুলের সাথে সংলগ্ন লক্ষ্মীপুর এইচ, এ সামাদ একাডেমিকে একত্রিকরণ করে বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর মডেল হাই স্কুল মাঠে এক বিশাল জনসমাবেশে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। নজরুলের আগমনণ বার্তা স্বল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। মানুষ প্রাণের উচ্ছ্বাস নিয়ে গ্রাম-গঞ্জ থেকে মডেল স্কুল মাঠে ছুটে আসেন। নজরুল তখন বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন। সংবর্ধনা সমাবেশে তিনি শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান। তিনি অন্যায়-অত্যচার এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা বলেছেন। তিনি কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে স্বরাজ কায়েমের পক্ষে ভোটদানের কথা বলেছেন। কবি সে বছর তার পার্টি থেকে ঢাকা বিভাগে কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য পদে নির্বাচন করছেন। পুরো মাঠ মন্ত্র মুগ্ধের মত কবির জ্বালাময়ী ভাষণ শুনেন। পরে কবি তাঁর সংগ্রামী কবিতা আবৃত্তি করেন এবং কৃষাণের গান, কান্ডারী হুঁশিয়ার, শিকল পরার গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। তিনি তাঁর ‘উঠরে চাষী জগদ্বাসী, ধর কষে লাঙল’ গানটি গাওয়ার সময় অপূর্ব ভঙ্গিমা ও দরাজ কন্ঠের টানে উচ্চসিত দর্শক-শ্রোতা করতালি ও উল্লাস ধ্বনিতে ফেটে পড়ে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবিকে স্বর্ণের মতান্তরে রূপার বাটি বা থালা উপহার দেয়া হয়। সেদিন নজরুলের পরণে ছিলো ধুতি, গায়ে জামা, মাথায় বাবড়ী চুলের উপর উঁচু গোল টুপি। সে বেশে তাঁকে খুব ভালো মানিয়েছিলো। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে কবিকে টাউন হলে (১৯১৯) নিয়ে আসা হয়। সেখানে তিনি দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলে সময় কাটান। টাউন হলের পশ্চিমের কক্ষে কবি রাত যাপন করেন।
কবি নজরুল ইসলাম নোয়াখালী থেকে লক্ষ্মীপুর আসেন। তাঁর আগমন পূর্ব নির্ধারিত রাজনৈতিক কর্মসূচীর অংশ কিংবা সংবর্ধনা সভায় যোগদান কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচীর পাশাপাশি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী তৃতীয়টিকে মেনে নেয়া যায়। আবু হেনা আবদুল আউয়ালের গবেষণা অনুযায়ী, নজরুলের আগমন ছিল ১৯২৭ সালে জুলাই মাসে। এ প্রসঙ্গে তিনি অনেক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। যেমন, পরের বছর ৪ঠা জুলাই নাট্যকার শ্রী মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮) কে লেখা পত্রে নজরুল লেখেন, ‘কিছুকাল আগে নোয়াখালী যাই। সেখান থেকে লক্ষ্মীপুরে গিয়ে সুধাংশু বলে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। বোধ হয় আপনিও চেনেন তাকে? নজরুলের সফরসঙ্গী ছিল দলীয় নেতা শ্রী হেমন্ত কুমার সরকার ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। মোঃ ফখরুল ইসলাম ‘তাঁর ‘বৃহত্তর নোয়াখালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, নজরুল ১৯২৭ সালে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নোয়াখালী সফর করেছেন। চট্টগ্রাম থেকে হাবীবুল্লাহ বাহারের এক টেলিগ্রাম পেয়ে কবিকে পরবর্তী এক সকালে নোয়াখালী থেকে বিদায় নিতে হয়। এসব প্রেক্ষিতে নজরুলের সফরের তারিখ ও সফর সঙ্গী কারা ছিলেন তা নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে।
আবু হেনা আবদুল আউয়াল লিখেছেন, নজরুল সোনাপুর (নোয়াখালী) থেকে অপরাহ্নে লক্ষ্মীপুরে এসে পৌঁছেন। নজরুলের সফর, সংবর্ধনা ও জলসায় সেদিন লক্ষ্মীপুরের নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রাণের বন্যা বয়ে যায়। প্রিন্সিপাল তোফাজ্জল হোসাইন লিখেছেন, এ অভ্যর্থনার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছিলেন লক্ষ্মীপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পানা মিয়া বেপারী (চৌধুরী)। জনশ্রুতি আছে, কবি নজরুল তার সংবর্ধনায় প্রাপ্ত উপহারের বদলে নগদ অর্থ পেলে বেশী উপকার হতো বলে জানিয়েছেন। তিনি পরদিন চাঁদপুরের পথে লক্ষ্মীপুর ত্যাগ করেন। চাঁদপুর থেকে স্টীমার যোগে কোন এক গন্তব্যে যাবেন।
নজরুলের সফর উপলক্ষে একটি সংবর্ধনা কমিটি গঠন করা হয়। রেজাউল হাকিম লক্ষ্মীপুর বার্তা ১৯৯৬ সালের ৩ জুন সংখ্যায় ‘লক্ষ্মীপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, সতেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী (সতু বাবু) কে সভাপতি ও আবদুল হাকিমকে সম্পাদক করে এ সংবর্ধনা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ ছিলেন, পানা মিয়া বেপারী (চৌধুরী), আবদুল মজিদ চৌধুরী, কালিময় ঘোষ, ফরিদ মিয়া, মুকুন্দ লাল নাগ, আবদুল লতিফ, ভারত চন্দ্র নাথ ও দুর্গা প্রসন্ন দে প্রমুখ। কমিটিতে পানা মিয়া বেপারী ছৌধুরী ছাড়া সকলে স্বনামধন্য উকিল ছিলেন।
লক্ষ্মীপুর উকিল বার ও টাউন হল যৌথভাবে নজরুল সংবর্ধনার আয়োজন করে। সে সময় লক্ষ্মীপুর টাউন হল মুন্সেফ ও উকিলদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ এবং সাবেক সাংবাদিক বাংলাদেশ বেতার
32Share