সাজ্জাদুর রহমান: বাজারে ইলিশের দাম চড়া, তাই বাসা বাড়িতে ঝুড়ি ভরে ইলিশ নিয়ে আসে ফেরিওয়ালা। দামেও কিছুটা সস্তা, কিনে ‘স্বস্তি’! তবে, খাওয়ার সময় বোঝা যায় সস্তার আসলে কি অবস্থা! ইলিশ নামে কেনা হলেও স্বাদ ও গন্ধে তার রুপালী ইলিশের ধারের কাছেও নেই। তাহলে ইলিশের নামে আমরা কি খাচ্ছি? পাঠক আসুন এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত জেনে নিই…
ঠিক ইলিশের মতই দেখতে এ মাছের বৈজ্ঞানিক নাম সার্ডিন (sardine, সামুদ্রিক পোনা মাছ বিশেষ)। এক সময় মেডিটারেনিয়ান দ্বীপ সার্ডিনিয়া’র চতুর্দিকে এ মাছের আধিক্য ছিলো বলে এরা সার্ডিন নামে পরিচিতি পেয়েছেন।
স্থানীয় ও জেলেদের কাছে পরিচিতি চন্দনা, যাত্রিক, টাকিয়া, পানসা, খায়রা ও সাগর চাপিলা নামে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সার্ডিন বা চন্দনা মাছকে ইলিশ বলেই বিক্রি করছে। এ মাছ বেশিরভাগ সাগরপথে আমদানি করা হয়। তাই ফরমালিনযুক্ত এ মাছ কিনে প্রতারিত হচ্ছে ভোক্তরা।
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে এ মাছ বিক্রি করতে দেখা যায়। পাশের জেলাগুলোতেও ইলিশ পরিচয়ে সার্ডিন মাছ বিক্রি করার খবর পাওয়া গেছে।
লক্ষ্মীপুর পৌর সমসেরাবাদ এলাকার গৃহিণী জাহানার বেগম বাংলানিউজকে বলেন, অচেনা এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ইলিশ কিনে আমি প্রতারিত হয়েছি।খাওয়ার সময় আমি বুঝতে পারি এ আসল ইলিশ না!
কমলনগরের ফলকন গ্রামের হারুন বলেন, স্থানীয় হাজিরহাট বাজারে মাঝারি সাইজের প্রতি কেজি ইলিশ এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। কিন্তু আলেকজান্ডার বাজার থেকে ইলিশ কিনলেন চারশ’ টাকায়। তবে খেতে বসে দেখি ইলিশের স্বাদ নেই। এভাবেই তার মতো ধোকায় পড়ছেন অনেকেই।
ইলিশ গবেষক, চিকিৎসক ও মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, সার্ডিন গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। এ মাছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান রয়েছে, খেতে বাধা নেই। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। তাই দেশে সার্ডিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণা চলছে।
সার্ডিন মাছ প্রাচুর্যতার জন্য শ্রীলংকা ও ভারতের উড়িষ্যা অঞ্চলে একক ফিশারি হিসেবে গড়ে উঠে। এছাড়া, সোনাদিয়া দ্বীপের দক্ষিণে ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এ মাছ বেশি আহরিত হয়ে থাকে। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার কম লবণাক্ত পানিতে এরা দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম হয়ে সার্ডিন মাছ লক্ষ্মীপুরে আসছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা স্থানীয় হাট-বাজার ও বাসা-বাড়িতে গিয়ে ইলিশ পরিচয়ে এ মাছ বিক্রি করছেন। যারা বিষয়টি জানেন না তারা ইলিশ ভেবেই কিনছেন।
স্থানীয় ইলিশ ব্যবসায়ীরা বাংলানিউজকে জানান, অসাধু ব্যবসয়ীরা চট্টগ্রাম থেকে চন্দনা মাছ এনে বিক্রি করছে। অনেকেই না জেনে কিনছে, এতে ইলিশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইব্রাহীম হামিদ শাহিন বলেন, সার্ডিন মাছের প্রাপ্তি বিগত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে বেশি। এ মাছ দেখতে ইলিশের মতো হওয়ায়, ইলিশ পরিচয়ে বাজারে বিক্রি হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকমর্তা আলেকুজ্জামান বলেন, ইলিশ ও সার্ডিন যেন সহজে চেনা যায় সে জন্য হ্যান্ডবিল ও পোস্টারের মাধ্যমে মানুষদের সচেতন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, সার্ডিন সামুদ্রিক মাছ। তবে ইলিশ পরিচয় বিক্রি করা প্রতারণা। এ মাছ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। এতে প্রচুর পরিমাণে উন্নতমানের পুষ্টি উপাদন আছে। এছাড়াও এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের দেশে সার্ডিন (চন্দনা ইলিশ) উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণা চলছে। এতে ইলিশের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। খেতে খেতে অভ্যস্ত হলে এটিও স্বাদের মাছ হয়ে উঠবে।
লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. বাসেদ মাহমুদ বলেন, সার্ডিন মাছ খেতে বাধা নেই। এতে ভিটামিন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম আয়রন ও সেলেনিয়ামের গৌণ খনিজ লবণ রয়েছে। সার্ডিন হলো সামুদ্রিক ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের প্রাকৃতিক উৎস্য যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তবে ফরমালিন যুক্ত যে কোনো খাদ্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর ও হুমকি স্বরুপ।
ইলিশের দেশে সার্ডিন মাছ। এমন পরিস্থিতিতে ইলিশ খেতে সচেতন হতে হবে। জেনে শুনে ও চিনে ইলিশ কিনতে হবে। তবে সার্ডিন খেতেও বাধা নেই।
সার্ডিন ও ইলিশ চেনার উপায়: সার্ডিনের দেহ পার্শ্বীয়ভাবে পুরু এবং পিঠের দিকের চেয়ে পেটের দিক অপেক্ষাকৃত উত্তল ও চ্যাপ্টা।
* ইলিশের দেহ পার্শ্বীয়ভাবে পুরু, পিঠের ও পেটের দিক প্রায় সমভাবে উত্তল।
* সার্ডিন বা চন্দনা ইলিশের দেহের দৈর্ঘ্য সাত সেন্টিমিটার থেকে বিশ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ইলিশ বেশ বড় (৭৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত) হয়ে থাকে।
* সারডিনের মাথার আকৃতি ছোট ও অগ্রভাগ ভোতা। ইলিশের মাথার আকৃতি লম্বাটে ও অগ্রভাগ সূচালো।
* সার্ডিনের পৃষ্ঠীয় পাখনার অগ্রভাগে এবং পুচ্ছ পাখনার কিনারা ঘোলাটে। ইলিশের পৃষ্ঠীয় পাখনার অগ্রভাগে এবং পুচ্ছ পাখনার কিনারা অনেটা সাদাটে।
* সার্ডিনের চোখের আকৃতি তুলনামূলকভাবে বড়। আসল ইলিশের চোখের আকৃতি তুলনামূলকভাবে ছোট।
* সার্ডিনের পার্শ্বরেখা বরাবর এক সারিতে আইশের সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৮টি। ইলিশের ৪০ থেকে ৫০টি।
* সার্ডিনের বুকের নিচে ধারালো কিল বোন বা স্কুইটস বিদ্যমান এবং স্কুইটস এর সংখ্যা ২৯টি থেকে ৩৪টি পর্যন্ত থাকে। ইলিশেল পেটের নিচে বিদ্যমান স্কুইটসের সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৩টি পর্যন্ত থাকে।
* সার্ডিনের পৃষ্ঠীয় পাখনার উৎসে একটি কালো ফোঁটা রয়েছে। আসল ইলিশের কানকুয়ার পরে একটি বড় কালো ফোঁটা এবং পরে অনেকগুলো কালো ফোঁটা (a series of small spots) থাকে।
* সার্ডিনের মাথার দৈর্ঘ্য দেহের আদর্শ দৈর্ঘ্যরে শতকরা ২২ থেকে ৩২ ভাগ হয়ে থাকে। ইলিশের মাথার দৈর্ঘ্য দেহের আদর্শ দৈর্ঘ্যরে শতকরা ২৮ থেকে ৩২ ভাগ হয়ে থাকে।
তথ্য সূত্র: (জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গ্রন্থ, পৃষ্ঠ-৭৯ থেকে ৮২)
প্রতিবেদক:ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট,লক্ষ্মীপুর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
0Share