কামরুল হাসান হৃদয়: লক্ষ্মীপুর শহরের বিভিন্ন এলাকার খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য মে দিবস শুধু একটি সাধারণ দিন। তারা জানে না, ১লা মে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে পালিত হয় বিশ্বের নানা প্রান্তে। তারা জানে না যে, এই দিনটি তাদের সংগ্রামের ইতিহাস, শ্রমের মূল্য এবং মর্যাদার কথা স্মরণ করার জন্য। তাদের কাছে এই দিনটি শুধুমাত্র একটি দিন, যখন তাদের কাজের বোঝা আরও ভারী হয়, অথচ তাদের পরিশ্রমের কোনো সঠিক মূল্যায়ন নেই।
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শিশু শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষক এবং শিক্ষকরা, প্রতিদিন তাদের জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু, তাদের অধিকাংশই জানেন না তাদের অধিকার সম্পর্কে। শ্রমিকদের জন্য গৃহীত আইন, শ্রমের সঠিক মূল্য এবং মৌলিক অধিকার—এসব তাদের কাছে অজানা। বরং তারা জানে শুধু কাজ করতে হবে, কারণ খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে শ্রম।
শিশু শ্রমিকদের জীবনযুদ্ধ:
লক্ষ্মীপুর শহরের অন্যতম এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১২ বছরের শিশু সোহান। তার গায়ের কাপড় ধূসর, চোখে ক্লান্তি। কাজের চাপে শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ। তাকে দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, কিন্তু তার পারিশ্রমিক মাত্র ১৫০-২০০ টাকা। সোহান জানে না শ্রমিক দিবস কিসের জন্য। তার কাছে এটি শুধু একটি নতুন দিন, যেখানে তাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু তার মনে কোনো আশা নেই। তার মতো লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় হাজারো শিশু শ্রমিকের কণ্ঠই অজানা, অশ্রুপূর্ণ।
শিক্ষকদের বেতনেও অবমূল্যায়ন:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লক্ষ্মীপুর শহরের একটি প্রাইভেট স্কুলে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন এক শিক্ষিকা। তিনি জানান, তার মাসিক বেতন মাত্র ৫,০০০ টাকা। বছরের পর বছর অতিরিক্ত ঘণ্টা ক্লাস ও শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে যাওয়া সত্ত্বেও, তার বেতন বাড়েনি। এই পরিস্থিতি শুধু এই শিক্ষিকার নয়, লক্ষ্মীপুরের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকারও একই অবস্থা। তারা শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি প্রাইভেট ক্লাস এবং অন্যান্য কাজ করে চলে যান, তবুও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য তারা পায় না।
একাধিক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সংশ্লিষ্টরা মাসের পর মাস বেতন আটকে রাখেন। ন্যূনতম এ বেতন থেকেও যদি বেতন আটকায় তাহলে জীবন চালনায় হিমশিম খেতে হয় বলে জানান ভুক্তভোগী এসকল শিক্ষকরা।
শ্রমিক দিবসে বঞ্চিতদের কণ্ঠ:
লক্ষ্মীপুরের শ্রমিকরা জানে না, ১লা মে শুধু শ্রমিক দিবস নয়, এটি তাদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও। আজকের দিনে পৃথিবীজুড়ে শ্রমিকরা তাদের সংগ্রাম, অধিকার, শোষণ এবং মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের শ্রমিকরা শুধুমাত্র জানে তাদের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের কথা। তারা জানে না, তাদেরও একটি অধিকার আছে—একটি মর্যাদা আছে। তবে, শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব তাদের কাছে আজও অজ্ঞাত।
এমনকি শ্রমিকদের বেশিরভাগই বুঝতে পারেন না, যে দিনের শেষে তাদের কাজের মূল্য নির্ধারণ করতে আইনগত অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকার কথা। আজকের দিনে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা তাদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করেন, তখন লক্ষ্মীপুরের শ্রমিকরা শুধু কাজের চাপে ক্লান্ত, তাদের কোনও দিনেও কেউ তাদের শ্রমের মূল্যায়ন দেয় না।
শিক্ষিত ও গুণীজনদের মন্তব্য:
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর মাইন উদ্দিন পাঠান বলেন, “শ্রমিক দিবস একটি বিশ্বজনীন আন্দোলন, যা শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদাকে সম্মানিত করতে চায়। তবে, আমাদের দেশে বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে, শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। লক্ষ্মীপুরের শ্রমিকরা জানে না তাদের অধিকার কী, তারা কীভাবে তাদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হতে পারে। সমাজের শিক্ষিত ও সুশীল মানুষদের উচিত, এই শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে জানানো। আইনগত সহায়তা, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা তাদের জন্য জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষকদের বেতন, শিশু শ্রমিকদের সমস্যা এবং শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ—এসব বিষয়ে সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সোচ্চার হতে হবে। শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠু আইন ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে, দেশের উন্নয়ন হবে অসম্পূর্ণ।”
মে দিবসের গুরুত্ব ও আমাদের দায়বদ্ধতা:
এই শ্রমিক দিবসে আমাদের প্রতিটি দায়িত্বশীল নাগরিকের উচিত, লক্ষ্মীপুরের শ্রমিক, শিশু শ্রমিক এবং শিক্ষকসহ সকল কর্মজীবী মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তাদের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। এই দিনটি শুধু একটি প্রতিবাদী দিন হওয়া উচিত, যা শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরকে সমাজে তুলে আনে।
88Share