আহম ফয়সল: ১২ জুলাই ১৯৯৬ পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা ত্যাগ করেন বিদায় নিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের অমর সাংবাদিক আহসান উল্যাহ মজুমদার। তার মৃত্যু আমাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দেয়। আজ ( ১২ জুলাই) তাঁর ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী। খুব অল্প সময়ের জন্য তাকে পেয়ে ছিলাম। আমার সংবাদিকতা জীবনের পরম শ্রদ্ধেয় গুরু ও এসময় কাল পর্যন্ত আমার দেখা অনন্য সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। কষ্টের স্মৃতিময় অনুভূতি, সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ, আজও আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় অমর সাংবাদিক আহসান উল্যাহ মজুমদারকে।
খুব ছোট বেলা থেকেই সংবাদপত্র চোখে পড়তো নিয়মিত। তাতে করে তখন থেকেই পড়ার অভ্যাসও তৈরী হয়। মফস্বলে বাড়ি হলেও বাবা নিয়মিত দৈনিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন ধরণের সাপ্তাহিক, মাসিক ম্যাগাজিন বাসায় আনতেন। তার পড়ার পর আমি তখন সেগুলো পড়ার সুযোগ পেতাম। এ ভাবেই সংবাদপত্রের প্রতি একটি নেশা তৈরী হয়। যেই নেশা এখনো রয়েই গেছে।
এক পর্যায়ে কলেজে যখন পা রাখলাম তখনই লেখাপড়ার পাশাপাশি পত্রিকায় লেখা-লেখি করার আগ্রহ তৈরী হলো। তখন সংবাদ বা সাংবাদিকতা সম্পর্কে কোন ধারনা ছিল না। বাবার সহযোগিতায় মনের ইচ্ছেকে পুজি করে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার রামগতি (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করার লিখিত অনুমতি পাবার পর ১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর পত্রিকায় আমার প্রেরিত প্রথম সংবাদ ছাপা হয়। সেই থেকে শুরু সরবে-নিরবে সাংবাদিকতার কাজটি শুরু। এলাকায় প্রতিদিনই অসংখ্য ঘটনা ঘটছে চারপাশে, খবরও পাচ্ছি। কিন্তু ঘটনাটি সংবাদ আকারে লেখার ঝামেলায় পড়তাম প্রতিনিয়ত। তখন সংবাদ লেখার কৌশল জানার জন্য একজন পথ প্রদর্শকের অনুভব করছিলাম প্রতিনিয়ত।
তখন রামগতি উপজেলার সাংবাদিক কে-বা কারা জানতাম না। আমার বাবার পরামর্শে রামগতির প্রবীণ সাংবাদিক ও রামগতি প্রেস কাবের প্রতিষ্টাতা সভাপতি আহসান উল্যাহ মজুমদারের ঠিকানা পেয়ে একদিন তার কাছে গেলাম। সংবাদপত্রের সাথে আমার কাজ করার আগ্রহ দেখে তিনি খুবই খুশি হলেন এবং প্রথম দিনই শ্রদ্ধেয় এই মানুষটি আমার সাংবাদিকতা শুরুর সাহসিকতার জন্য উৎসাহ দেন। প্রতিদিন বিকেলে ছুটে যেতাম তার কাছে। প্রতিদিনই নতুন-নতুন কিছু শিখে বাড়ি ফিরতাম। একটি নোট বই সব সময় সাথে রাখার পরামর্শ দিয়ে আমাকে সাংবাদিকতার কৌশল শেখাতে শুরু করেন। আহসান উল্যাহ মজুমদার তখন বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। দৈনিক রূপালী, দৈনিক সংগ্রাম ও জেলা সদর লক্ষ্মীপুর থেকে বহুল প্রচারিত ‘সাপ্তাহিক এলান’ পত্রিকার প্রতিনিধি, কখনো কলাম লেখক, কখনো সম্পাদনা সহকারীর দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। অসাধারণ এই প্রতিভাবান ব্যক্তি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যও ছিলেন।
আহসান উল্যাহ মজুমদার সাংবাদিকতার পাশাপাশি স্থানীয় চর কোলাকোপা কারামতিয়া কামিল মাদ্রাসার শিকতা (বাংলা) শেষে প্রতিদিন বিকেলে জমিদার হাট বাজারের একটি দোকানে হোমিও ডাক্তারি করতেন। তার কাছ থেকে নাম মাত্র মূল্যে ঔষধ নিতে ভিড় লেগে যেত রোগীদের। এত কিছুর পরও তার বর্নাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের বর্ননা-অবর্ননীয়। ৯০ এর দশকে বই পড়ার জন্য দেশের শত পাঠকের মধ্যে আহসান উল্যাহ মজুমদার একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঔষধের দেকানে দুটি স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসের আলমিরাতে সারি-সারি ঔষধ সামগ্রী। দোকানের পেছনের দিকে বিস্তর জায়গা। এটি অন্য আরেক জগৎ। লাখ বই, পত্রিকা, ম্যগাজিনে ভরপুর।
আহসান উল্যাহ মজুমদারের মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিক রেজাউল হকসহ কয়েক জনের সাথে পরিচয় হয়। এ কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে তিন মাসের মাথায় আমাকে রামগতি প্রেস কাবের কোষাধরে দায়িত্ব দেন তিনি। তখন তিনি (আহসান উল্যাহ মজুমদার) সভাপতি, রেজাউল হক সাধারন সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। অকৃপণ এই মহতী মানুষটির কাছে যতই যেতাম, ততই যেন কিছুনা কিছু শিখতাম। কথোপকথন, আলোচনায় শিখতাম তার কাছ থেকে।
নির্ভীক এই সাংবাদিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বার্থহানীর রোষানলে পড়ে বেশ কিছুদিন কারা জীবনও অতিবাহিত করেছেন। আহসান উল্যাহ মজুমদারের লেখা বহু নাটক, গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে। বাংলা একাডেমির মাসিক সাময়িকি ‘বই’ নামক সংকলনে লিখতেন নিয়মিত। খুব স্বভাবিক জীবন-যাপনকারী এই সাংবাদিককে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য সবসময় পরামর্শ দিতেন আরেক গুনধর সাংবাদিক ও রামগতির সন্তান সানাউল্লাহ নূরী। আহসান উল্যাহ মজুমদারকে তিনি (সানাউল্যাহ নূরী) বলতেন, ‘গ্রমে পড়ে থেকে যত ভালো সাংবাদিকতা কর না কেন, কোন লাভ নেই। ঢাকায় থাকলে এতদিনে আমার মত তুমিও একটি পত্রিকার সম্পাদক হতে পারতে’। আহসান উল্যাহ মজুমদারকে উৎসাহ দিতেন ঢাকায় যাবার জন্য, থাকার জন্য।
কিন্তু না এলাকার মানুষের কাছে যেন তার ছিল দায়বদ্ধতা। শেকড়ের টান তিনি ছিড়তে পারেন নি। তার জন্য মনে কোন আপে ছিল না অহসান উল্যাহ মজুমদারের। ব্যক্তি, সংসার, শিকতা, তৃনমূলে থেকে সাংবাদিকতা করা, চিকিৎসা সেবাকে কখনোই ছোট করে দেখেননি আহসান উল্যাহ মজুমদার। মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতেন প্রাত্যহিক কাজ নিয়ে। চিকিৎসা শাস্ত্র হোমিও ডাক্তারি করে তিনি মানুষকে সেবাই দেন নি, হোমিও শাস্ত্রকে নিয়ে তিনি গবেষণা করতেন সবসময়। হোমিও শাস্ত্রের ওপর গভেষনা ধর্মী একটি বই প্রকাশের আগ্রহ নিয়ে কয়েক বছর ধরে নিয়মিত লিখে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত দীর্ঘ গবেষণার ফসলটি অপ্রকাশিতই থেকে গেল।
একজন নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে আহসান উল্যাহ মজুমদারের বেশ সু-খ্যাতি ছিল। কোন অফিসের ধারে-ধারে ঘুড়ে বেড়াতে দেখা যায়নি তাকে। যত দিন, যতবার দেখা করতে বা কাজে গিয়েছি তার কাছে, প্রতিবারই তিনি কিছু না খাইয়ে ছাড়েননি আমাকে। বহু দিন আহসান উল্যাহ মজুমদার স্যারকে কিছু একটা খাওয়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। শুধু কি সাংবাদিকতাই শিখেছি তার কাছ থেকে, তা নয়- তার দেয়া ঔষধ খেয়ে বসন্ত রোগের দূ:সহ যন্ত্রনা থেকে খুব অল্প সময়ে মুক্তি পেয়েছি। সেটি ছিল আমার নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার মতই।
হঠাৎ একদিন খবর পেলাম আহসান উল্যাহ মজুমদারকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। উচ্চ রক্ত চাপে ব্রেনে তার রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ছট-ফট করছেন হাসপাতালের বিছানায়। এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে অনেক কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। পরবর্তীতে হাসপাতালে ৪/৫ দিন চিকিৎসাধিন অবস্থায় ১২ জুলাই ১৯৯৬ পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা ত্যাগ করেন আহসান উল্যাহ মজুমদার। তার মৃত্যু আমাকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দেয়। খুব অল্প সময়ের জন্য তাকে পেয়ে ছিলাম। আমার সংবাদিকতা জীবনের পরম শ্রদ্ধেয় গুরু ও এসময় কাল পর্যন্ত আমার দেখা অনন্য সাদা মনের মানুষ ছিলেন তিনি। কষ্টের স্মৃতিময় অনুভূতি, সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ, আজও আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় অমর সাংবাদিক আহসান উল্যাহ মজুমদারকে।
0Share