এমআর সুমন: এত পানি আমি আগে দেখিনি। শুধু আমি না, অনেক মুরব্বির সাথে কথা বলেছি তাঁরাও দেখেননি। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, দেখে মনে হচ্ছে পুরো গ্রাম যেন নদী ও খালের মত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংকট ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন কাজগুলো নিম্মমানের হওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে বেশি।
কথাগুলো বলছিলেন উপজেলার চরআবাবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদ উল্যা বিএসসি। তিনি বলেন, এমন কান্ড ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাসেও দেখা যায়নি। বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট সব প্লাবিত হয়ে ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুর ও মুরগি খামার। ঘরের ভেতরে পানিতে থই থই অবস্থা। ৩-৪ দিন পর্যন্ত রান্না করতে পারেননি অনেকে। কর্মজীবী মানুষ গৃহবন্দি।
তিনি বলেন, গ্রামে ঘর-বাড়ি তৈরিতে কেউ কোনো নিয়ম মানছেন না। ড্রেন দখল ও পানি নিষ্কাশনের জায়গা না রেখে ঘর নির্মাণ করায় পানি নামতে পারে না। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ বয়ে এনেছে হাজিমারা এলাকার ডাকাতিয়া নদীর ওপর নির্মিত অপরিকল্পিত স্লুইচ গেট। এই গেটগুলো বহু বছর অকেজো হয়ে আছে। বহুবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ এগুলো সংস্কার না করায় পানি এখানে বাধা পেয়ে দুই পাশের গ্রামে ঢুকে পড়ে। এর ওপর ছিল প্রবল বৃষ্টি। তাই পুরো গ্রামে নজিরবিহীন পানি ওঠে যায়।
হায়দরগঞ্জ বাজারের মহি উদ্দিন অভিন্ন মত প্রকাশ করে বলেন, এমন পানি কেউ দেখেনি। গ্রামের ৩০টির মতো পুকুর ও মৎস্য খামার ভেসে গেছে। আমার পুকুরও ভেসে বহু টাকার মাছ নষ্ট হয়েছে। শুধু চরাঞ্চল নয়, এ বৃষ্টিতে নজিরবিহীন জলাবদ্ধতায় নাকাল সমগ্র উপজেলার লাখ লাখ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ছয় দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার সর্বত্র নজিরবিহীন এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে চরবংশী, চরআবাবিল, চরমোহনা, সোনাপুর, কেরোয়া, বামনী, চরপাতা উত্তর ও দক্ষিন চরবংশী ও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের বহু গ্রামের সাথে অন্যান্য গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কৃষকের জমিসহ গ্রামের বাড়ি ঘর ছাড়াও স্কুল, কলেজে পানি ঢুকে পানি বন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়ি নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের পথ না রাখাসহ বিভিন্ন কারণে এ বছর রায়পুরে নজিরবিহীন এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।
পৌর সভার বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও খাল ভরাটের ফলে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে হালকা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় পুলো পুরো সভায়।
পৌর সভার মেয়র ইসমাইল খোকন বলেন, এবারের বৃষ্টিতে রায়পুরের মানুষের অনেক ভোগান্তি হচ্ছে। দোকান পাটসহ ঘরে ঘরে পানি ঢুকে স্বাভাবিক কাজকর্ম, রান্না-বান্না সব বন্ধ হয়ে যায়। তিনিও এর নেপথ্যে ড্রেন খাল দখলকে দায়ী করে বলেন, গ্রামের মানুষ যেমন খুশি ঘর-বাড়ি নির্মাণ করছে। পানি নামার জায়গাও রাখছে না। তাই যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে তখন নিজেরাও এভাবে কষ্টে পড়ে যান। তবে এ বছর জলাবদ্ধতাকে অন্যতম প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে তা নিরসনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
রায়পুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ বলেন, রায়পুরে বৃষ্টি-বন্যা বহুবার হয়েছে। কিন্তু এমন পানি আগে দেখিনি। এলাকার মানুষ বলছে তারাও দেখেননি। জলাবদ্ধতায় গ্রামের সড়ক, বাড়ি-ঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জলাবদ্ধতার জন্য স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিও দায়ী বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা সরকারি খাল পাড়ের জায়গা কিনে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে বৃষ্টিতে জমে যাওয়া পানি নামতে পারেনি।
এ বিষয়ে রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন শহিদ সরোয়ারদী বলেন, টানা বৃষ্টির কারণেই বেশির ভাগ জমি প্লাবিত হয়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অনেক জমিতে পানি জমে থাকে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আমরা এখনো নির্ধারণ করিনি।
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরীন চৌধুরী বলেন, গত কয়েক দিনের টানা মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতেই এখানে যে অবস্থা হচ্ছে তা ভাববার বিষয়। আমার বাসার নিচতলাও পানিতে তলিয়ে যায়। পুরো উপজেলা পরিষদ এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে সমগ্র উপজেলাতে এভাবে জলাবদ্ধতায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
0Share