তাবারক হোসেন আজাদ: রায়পুর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের সড়কগুলোর ৫ বছরেও সংস্কার নেই। বেহাল দশার সড়কগুলো পারাপার হতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ । গত তিন বছরে সড়ক উন্নয়নের জন্য ২১ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্ধ হলেও ওই টাকা পৌর কতৃপক্ষ ও সুবিধাবাদি আ’লীগ নেতারা মিলেমিশে লুটপাট করে খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে ট্রাফিক মোড়ে সড়কের গভীর খাদ। কিন্তু ৬ মাস আগে দেড়লাখ টাকা ব্যায়ে এ খাদটি ভরাট করা হয়েছিল। এই খাদে পড়ে প্রতিদিনই নাকাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের পাশেই সড়কের উপর ডাস্টবিনে ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে ঢুকতে হয় মুখে রুমাল গুঁজে। আর শহরের কয়েক জায়গায় সড়কবাতি থাকলেও বেশিরভাগ সড়কে বাতি না থাকায় সন্ধ্যা নামলেই ভুতুড়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় গোটা শহর এলাকা। রায়পুর পৌর এলাকায় এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। অথচ পৌরবাসী নিয়মিত পৌরকর দিচ্ছেন। প্রতিটি নির্বাচনের আগে প্রার্থীরাও পৌরসভাকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ১৫ বছরের পুরনো এই পৌরসভার নাগরিকরা তাদের কাক্ষ্মিত নাগরিক সেবা আজও পাননি।
রায়পুর শহরের একাংশ (৯৭ বর্গকিমি.) এলাকা নিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রায়পুর পৌরসভা। এজন্য ১৫টি গ্রামকে ৯টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকাকে শহর এলাকা ঘোষণা করে রায়পুর পৌরসভার আওতায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ১৫ বছর পার হলেও পৌরসভাটি আজও একটি পূর্ণাঙ্গ পৌরসভা হয়ে উঠতে পারেনি। পৌরসভার প্রাণকেন্দ্র রায়পুর বাজারটিতে প্রতিদিন অন্তত লক্ষাধিক লোকের যাতায়াত। কিন্তু বাজারে ঢোকার সড়কটিকে ঠিক পাকা সড়ক বলে চিনতে পারা কঠিন। সড়কের পিচ ও পাথর উঠে গেছে বহু আগেই। ময়লা-আবর্জনা ও খানা-খন্দকে ভরা এই সড়কে নির্বিঘেœ হেঁটে চলাও কঠিন। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় অল্প বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যায় পুরো সড়ক।
স্থানীয়দের অভিযোগ- এসব সমস্যার কথা বলে বলে তারা এখন ক্লান্ত। তাই অভিযোগ করাও ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। রায়পুর মার্চ্চেন্টস একাডেমী, পাইলট বালিকা ও এলএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় শুধু রায়পুর উপজেলা নয়, গোটা লক্ষ্মীপুর জেলারই অন্যতম নামকরা স্কুল। এসব স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ হাজারেরও বেশি। স্কুলের সামনের থানা সড়কে জমে থাকা নোংরা পানি ও কাদা মাড়িয়েই নিত্যদিন শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু এই রাস্তাটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। রাস্তাটি পরিষ্কার রাখার উদ্যোগও নেয় না পৌরসভা।
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতা রায়পুর পৌরসভার আরেকটি বড় সমস্যা। বৃষ্টি হলেই শহরের গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি স্থানসহ দেনায়েতপুর, কাঞ্চনপুর, দেবীপুর, পূর্বলাছ, কেরোয়া গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে তারা এসব সমস্যার কথা বলে আসছেন। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ কেউ নেয় না। কাঞ্চনপুর, দেবীপুর ও দেনায়েতপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া মহাসড়ক ও পৌরবাজার সংযোগ সড়কটিও খানা-খন্দকে ভরা। বৃষ্টি হলেই এটি চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়ে। অথচ এই সড়ক ধরে যাতায়াত করে এখানকার মাচ্চেন্টস একাডেমী, পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এখানে আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মিলন কেন্দ্র জগন্নাথ জিউর আখড়া।
কাঞ্চনপুর-দেনায়েতপুর গ্রামের মধ্যবর্তী সংযোগ টিএনটি সড়কটির অবস্থা এতই খারাপ যে, দিনের বেলায়ও রিকশা উল্টে যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। পৌর ৭নং ওয়ার্ডের মিরগঞ্জ সড়কটির অবস্থাও করুণ। রায়পুর থানা থেকে লক্ষ্মীপুর-চাঁদপুর-হায়দরগঞ্জ- পানপাড়া পর্যন্ত সড়কটি সংস্কারের অভাবে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের অনেক কাঁচা রাস্তা এখনও পাকা করা হয়নি। বৃষ্টি হলেই এসব সড়কে যাতায়াত করা দুষ্কর হয়ে পড়ে।
পৌরসভার আওতাধীন অনেক গ্রামে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট। এসব এলাকার বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে দূষিত ও ময়লা পানির ওপর দিয়েই চলাচল করেন। অধিকাংশ ওয়ার্ডে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। ফলে পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানিরও সংকট রয়েছে। তাই বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। সবচেয়ে বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বৃদ্ধরা।
পৌরসভার সব সড়ক, নর্দমা, আবাসিক ভবন থেকে আবর্জনা সংগ্রহ ও অপসারণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া ময়লা ফেলার জন্য কোনো ডাস্টবিন বা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় পৌর এলাকার প্রাণকেন্দ্র পৌর বাজার এলাকাটি ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বলা যায়, পুরো পৌর এলাকায় যেখানে সেখানে আবর্জনা জমে একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
পৌর এলাকার রাস্তাগুলোতে সড়ক বাতি না থাকায় পথচারীরা অন্ধকারে ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন নিয়মিত। রায়পুরে ৪০ বছরেও জ্বালানি গ্যাস পৌঁছেনি ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হয়নি। যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ না করেই পৌর এলাকার যত্রযত বহুতল ভবন নির্মাণও একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা পৌরসভার নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কেউই শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আগামী পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে আবারও শুরু হয়েছে নানা প্রতিশ্রুতির প্রচারণা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়ন বঞ্চনার জন্য একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েছেন।
পৌরসভার মেয়র এবিএম জিলানী বলেন, পৌরসভার উন্নয়ন না হওয়ার প্রধান কারণ অর্থ সংকট। এখানে পর্যাপ্ত বাজেট দেয়া হয় না তাই উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। আসন্ন নির্বাচনে থানা আওয়ামী লীগের সদস্য ও অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মন্সী মেয়র হিসেবে নির্বাচন করার জন্য জনসংযোগ করছেন। পৌরসভার কাঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য স্থানীয় এমপি যখন থাকে আওয়ামী লীগের তখন মেয়র হন বিএনপির লোক। তাই কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে তার প্রথম কাজ হবে পৌর এলাকায় উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন। এ দুটোই এলাকাবাসীর প্রধান দাবি।
0Share